Thursday, March 14, 2024

ডলারের রাজত্ব, যেভাবে শুরু হল

 


কল্পনা করুণ, প্রাচীন কালে একজন কৃষকের কথা। কৃষক ধান চাষ করে। নিজের জন্য যতটুকু দরকার ততটুকু ধান রেখে বাকি অংশ দিয়ে দিলো একজন জেলের কাছে।

কতটুকু ধানের বিনিময়ে জেলে কতগুলো মাছ বিক্রি করবে, সে বিষয়ে যাবো না।
একেবারে সহজ ভাবে চিন্তা করূণ।
বিনিময় প্রথাতে, একটি পণ্যের বিনিময়ে আরেকটি পণ্য পাচ্ছেন।
সমস্যা হল,
এই পণ্যগুলো পচনশীল।
ধরূণ একজন মাছ বিক্রেতা ৬টি কাতল মাছ দিয়ে ১০টি মুরগী চাচ্ছে।
কিন্তু এলাকায় যে মুরগী পালে,
তার কাছে বিনিময় যোগ্য মুরগী আছে ৫টি।
আরেকটি সমস্যা হল, মুরগী খামারি কাতল মাছ খেতে পছন্দ করে না।
আবার চিন্তা করুণ, ধার বা ক্রেডিট নেওয়ার প্রয়োজন হল।
ধান বিক্রেতা মুরগীর খামারির কাছে ৫টি মুরগী চাচ্ছে।
কিন্তু এমুহুর্তে বিনিময় করার মত ধান তার মজুদ নেই। মাঠে এখনো ধান পাকেনি।
৫টি মুরগী ধার করে নিয়ে ভবিষ্যতে ৫ কেজি ধান দেওয়ার চুক্তি তাকে করতে হবে।
এরকম প্রতিমূহুর্তে ক্রেডিট তথা ধার নিতে গেলে তো সমস্যা।
এভাবেই প্রয়োজনের তাগিদেই এসেছিল মুদ্রার কনসেপ্ট।
ধরূন, ১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের টুকরা। এই ১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণের টুকরাকে গ্রামবাসী সবাই মিলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলো। সবাই মিলে আস্থা রাখলো। স্বর্ণ চাইলেই পাওয়া যায় না মাটি বা পানির মত। এর সাপ্লাই নিয়ন্ত্রিত। সে সাথে স্বর্ণ অপচনশীল। ফেলে রাখলে নষ্ট হয় না।
ধরূণ, কৃষক ১০ মন ধান বিক্রি করে বিনিময়ে ১ কেজি স্বর্ণ মুদ্রা নিলো। অর্থাৎ ১০০০টি ১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ মুদ্রা। এরপর ২০০ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে সে মুরগী কিনলো।
২০০ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে মাছ কিনলো।
বাকি ৬০০ স্বর্ণ মুদ্রা থেকে ৫০০ স্বর্ণ মুদ্রা অন্যকে ধার দিয়ে সুদের ব্যবসা শুরু করলো।
বাকি ১০০ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে কিছু মানুষ ভাড়া করে নিজের জমিতে বর্গা খাটানো শুরু করলো। আর নিজে পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে চিল করতে লাগলো।
বাস্তবে Lydia তে প্রথম ২৬০০ বছর আগে প্রথম স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন হয়। স্বর্ণ মুদ্রার সমস্যা হল,
বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মুদ্রা বহন করা ঝামেলা। সে সাথে স্বর্ণ মুদ্রায় ভেজাল মেশানোর চান্স থাকে।
উপরের উদাহারণের কথা চিন্তা করুণ।
প্রতিটি স্বর্ণ মুদ্রাতে ১ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ আছে, এটা নিশ্চিত করতে তো সমগ্র বিষয়টা Centralized এবং নিয়ন্ত্রিত করা লাগবে। অর্থাৎ দরকার সরকার বা Bank বা অন্যকোনো Centralized institution যে এসব নিয়ন্ত্রন করতে পারবে। অন্যথায় সারাদিন দাড়িপাল্লা নিয়ে ঘুরতে হবে।
সোজা বাংলায়, সরকার তথা Government, Leadership, bank, institutions এসব ছাড়া মুদ্রা কনসেপ্টের বাস্তবায়ন তখন সম্ভব ছিল না সম্ভবত। এযুগে অবশ্য Blockchain / bitcoin এসব আছে যা দিয়ে সরকার/ Govt ইগনোর করা সম্ভব।
যাই হোক, সময়ের পরিক্রমায় এসেছিল পেপার নোট।
চাইনিজরা প্রথম পেপার নোট চালু করে।
বিষয়টা সহজ করে বলি।
ধরূন উপরের উদাহারণের কথা। ওই কৃষক আব্দুল রহিম আস্তে আস্তে জমিদার হয়ে গেল।
এখন সে টনকে টন ধান বিক্রি করে।
এতো পরিমাণ ধানের বিনিময়ে হাজার হাজার কেজি স্বর্ণ তাকে নিতে হয় যা একদিকে বাড়িতে রাখা বিপদ। কারণ বিশাল ভল্ট দরকার হয়। সেসব ভল্ট পাহারা দিতে দরকার হয় বিপুল পরিমাণ জনবলের।
চুরি ডাকাতির ভয় থাকে।
সে সাথে প্রতিবার লেনদেন করার সময় গরূর গাড়ি বোঝায় করে স্বর্ণ নিতে হয়। একবার তো রাস্তায় ডাকাতিও হয়েছিল।
তো তখন এলো ব্যাংক নোট।
ব্যাংক স্বর্ণ নিজের ভল্টে রেখে সমপরিমাণ কাগুজে নোট ছেড়ে দিলো। ধরূন একটি নোটের উপর লিখা ১০। অর্থাৎ ওই ১০ লিখা নোট ব্যাংকে দিলে ব্যাংক ১ গ্রাম স্বর্ণ দিবে, এমনই সিস্টেম চালু হল। এই সিস্টেমটাও প্রথম চালু করেছিল চীন। শুরু হল Gold Backed Currency অধ্যায়। এই সিস্টেম পরবর্তীতে ইউরোপ কপি পেস্ট করেছিল।
যেমন ১৪৬৪ সালে ইংল্যান্ডের ১ পাউন্ড স্টারলিং ছিল ১৫.৪৭ গ্রাম Fine Gold-এর সমান। অর্থাৎ আপনার পকেটে যদি তখন ৬৪ পাউন্ড থাকে, তার মানে হল আপনি পকেটে করে ১ কেজি স্বর্ণের সমান অর্থ নিয়ে ঘুরতেছেন।
আবার ১৮১৬ থেকে ১৯১৪ সাল, এই সময়কালে ইংল্যান্ডের ১ পাউন্ড স্টারলিং ছিল ৭.৩ গ্রাম Fine Gold-এর সমান।
অর্থাৎ আপনার পকেটে যদি তখন ১৩৭ পাউন্ড থাকে, তার মানে হল আপনি পকেটে করে ১ কেজি স্বর্ণের সমান অর্থ নিয়ে ঘুরতেছেন।
দীর্ঘ সময়কালে Currency অবমূল্যায়ন হয়েছে। তবে মুদ্রা কিন্তু Represent করতো স্বর্ণকে। কম হোক বা বেশি।
একটা উদাহারণ দিয়ে বলি।
ধরূন ১৯০০ সালের কথা।
ইংল্যান্ডের Currency তখন পাউন্ড স্টারলিং এবং ১ পাউন্ড তখন ৭.৩২ gm স্বর্ণের সমান।
তো ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে কয়লা প্রয়োজন। কয়লা ক্রয় করা হবে জার্মানি থেকে।
জার্মানির মুদ্রা তখন Goldmark
এখন ইংল্যান্ডের টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিতে ১০০ টন কয়লা লাগবে, এবং জার্মানির একটি কয়লা কোম্পানির সাথে প্রতি টন ১০ পাউন্ড হারে ইংল্যান্ডের ফ্যাক্টরিটি কয়লা ক্রয়ের চুক্তি করলো।
১০০ টন কয়লার জন্য ইংল্যান্ড ১০০ x ১০ = ১০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড দেবে জার্মানিকে।
ইংল্যান্ডের ওই টেক্সটাইল ফ্যাক্টরিটি কিন্তু কয়লার বিনিময়ে ফিজিক্যালি স্বর্ণ জার্মানিতে পাঠাচ্ছে না।
পাঠালে সেক্ষেত্রে ১০০০ x ৭.৩২ গ্রাম অর্থাৎ ৭.৩২ কেজি স্বর্ণ পাঠাতে হতো।
তা না করে ফ্যাক্টরিটি দেবে Bill of Exchange যা মুলত একটি ১০০০ ব্রিটিশ পাউন্ডের চেক। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল, এই চেকটি নির্দিষ্ট ব্রিটিশ ব্যাংকে জমা দিয়ে যদি সমভ্যালুর স্বর্ণ দাবি করা হয়, তাহলে ওই পরিমাণ স্বর্ণ ব্যাংকটি দিতে বাধ্য।
ইংল্যান্ডের কাছ থেকে পাওয়া Bill of Exchange-টি নিয়ে জার্মান কয়লা কোম্পানি কি করবে?
তার স্বর্ণের দরকার আছে? নাহ। নাই।
তার দরকার জার্মান মুদ্রা গোল্ডমার্কের।
যে মুদ্রা দিয়ে তারা কর্মচারিদের বেতন ভাতা দেবে।
তো কয়লা কোম্পানি ওই Bill of Exchange-টি জার্মান ব্যাংকে জমা দিলে ৭.৩২ কেজি স্বর্ণের Equivalent জার্মান মুদ্রা, অর্থাৎ Goldmark কোম্পানিটি পেয়ে যাবে।
কারণ জার্মানির মুদ্রা Goldmark-ও ব্রিটিশ পাউন্ডের মতই Gold backed.
যদি ১ গোল্ড মার্ক সমান ১ গ্রাম স্বর্ণ হয়, তাহলে উপরোক্ত Bill of Exchange-টি জমা দিয়ে জার্মান কয়লা কোম্পানিটি ৭৩২০ গোল্ড মার্ক পাবে।
সে হিসেবে, ১০০০ ব্রিটিশ পাউন্ড = ৭৩২০ গোল্ডমার্কের সমান।
অর্থাৎ এটাই ওই সময়ে জার্মানি ও ইংল্যান্ডের ভেতর মুদ্রা বিনিময় হার।
১৯৩০ সালের আগে একজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ব্যাংকে গিয়ে ডলারের বিনিময়ে স্বর্ণ এক্সচেঞ্জ করতে পারতেন। কিন্তু এই জিনিসটা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট এসে বন্ধ করে দেন। তবে বড় বড় ব্যাংক এবং অন্যকোনো দেশ ইচ্ছা করলে ডলারের বিনিময়ে গোল্ড এক্সচেঞ্জ করতে পারতো।
কতগুলো বিষয় এবার মাথায় আনুন গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি সিস্টেমের জন্য।
ধরূন, ইরান তার দেশে তৈরি পোশাক রফতানি করেছে ইংল্যান্ডে।
তো বিনিময়ে পেমেন্ট পেয়েছে ব্রিটিশ পাউন্ডে।
এই ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়ে তারা ইংল্যান্ডের কিছু জিনিস পাতি কিনতে পারে। অথবা জমা করে রাখতে পারে রিজার্ভ হিসেবে।
কথার কথা, ফ্রান্সের কাছ থেকে ইরান কিছু জিনিসপাতি কিনবে। জিনিসপাতির বিনিময়ে ফ্রান্সকে ইরান তার নিজের কারেন্সিতে পেমেন্ট করতে চাইলো। কিন্তু ফ্রান্স বললো, তোমার কারেন্সির প্রতি আমার আস্থা নাই। তোমার দেশেরই ভরসা নাই। কারেন্সি তো দূর কি বাত। তুমি আমাকে বরং মার্কিন ডলার বা ব্রিটিশ পাউন্ডের মত কারেন্সিতে পেমেন্ট করো। অথবা ডাইরেক্ট স্বর্ণ দিতে পারো।
তো ইরান তাদের কাছে সেই মজুদ ব্রিটিশ পাউন্ড দিয়ে এই দফায় পেমেন্ট করে দিলো।
ফ্রান্সও পেমেন্টটি নিলো কারণ ব্রিটিশ পাউন্ডের প্রতি তাদের আস্থা আছে। তারা জানে, ইচ্ছা করলেই ইংল্যান্ডের ব্যাংকে গিয়ে ব্রিটিশ পাউন্ডের বিনিময়ে তারা গোল্ড পেয়ে যাবে। ভুগিযুগি হবে না।
আচ্ছা, কেমন হবে যদি ইংল্যান্ডের কাছে মজুদ স্বর্ণ খুবই কম থাকে। অর্থাৎ চাহিবা মাত্র ব্রিটিশ পাউন্ড স্বর্ণে কনভার্ট করে দিতে তারা ব্যর্থ হয়? তখন? তখন তো ঝামেলা হয়ে যাবে।
সূতরাং ইংল্যান্ড যখন কোনো দেশকে Bill of Exchange-এর মাধ্যমে ব্রিটিশ পাউন্ডে পেমেন্ট করবে, তখন এই বিষয়টা তাকে মাথায় রাখতে হবে। সে চাইলেই ইচ্ছামত Currency ছাপাতে পারবে না। নিশ্চয় বুঝতেই পারতেছেন, এহেন সিস্টেমে ইউনিভার্সেল কারেন্সি হয়ে যাবে সেই দেশের মুদ্রা, যে দেশের কাছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ আছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে পৃথিবীর অবস্থা চিন্তা করূন।
সবগুলো ইউরোপিয়ান দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত।
ইংল্যান্ডের মত দেশ আমেরিকার কাছ অর্থ ধার করতেছে যুদ্ধের জন্য। ইউরোপিয়ান দেশগুলো নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমেরিকার মেইনল্যান্ডে তখন সে যুদ্ধের আচও পড়তেছেনা।
এর আগে পৃথম বিশ্বযুদ্ধেও এমনই হয়েছিল।
গোটা ইউরোপ যখন যুদ্ধ করতেছিলো, আমেরিকা তখন ব্যবসা করেছে আরামছে। হেনরি ফোর্ড ব্যবসা করেছে সমানে। আমেরিকার ব্যবসায়ী পিয়েরে ডু পন্ট তখন ইউরোপে গান পাউডারের ব্যবসা করে বস্তা বস্তা অর্থ কামিয়েছে।
এই ডু পন্ট পরে General Motors কিনে নিয়েছিলো।
এরপর তো আমেরিকার বিখ্যাত Empire State Building বানিয়েছিলো গাড়ি ব্যবসায়ী ওয়ালটার ক্রাইসলারের সাথে টেক্কা দিয়ে। Empire State Building-থেকে পাঁচ মিনিট দূরুত্বে Crysler Building
তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে ইউরোপ বিধ্বস্ত। অন্যদিকে আমেরিকা দুনিয়ার সেরা অর্থনীতি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে উডস চুক্তির মাধ্যমে IMF এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের জন্ম হয়। আর ডলার হয়ে যায় ইউনিভার্সেল কারেন্সি।
সে সময়ে আমেরিকার কাছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ ছিল। এজন্যেই মার্কিন ডলারকে ইউনিভার্সেল কারেন্সি হিসেবে মেনে নেয়া হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঙ্গীকার করেছিল যে ৩৫ মার্কিন ডলার= ১ আউন্স স্বর্ণ Rate অনুযায়ী যেকোনো দেশ চাওয়া মাত্র ডলারের রিজার্ভ ভাঙ্গাতে পারবে। ব্যস, তখন থেকে মার্কিন ডলারে অন্যান্য সকল দেশ তাদের রিজার্ভ রাখতে শুরু করে।
এবার একেবারে সিমপ্লিফাইড ওয়েতে একটা পরিস্থিতি কল্পনা করুণ।
ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে,
১ আউন্স স্বর্ণের মুল্য ৩৫ মার্কিন ডলার।
কথার কথা, আমেরিকাতে বিভিন্ন পন্য রফতানি করে ফ্রান্স ১৪০০ মার্কিন ডলার কামিয়েছে। এবং এই অর্থটা আমেরিকাতেই সে রিজার্ভ আকারে রেখেছে। অর্থাৎ সোজা কথা হল, ফ্রান্সের ফরেন রিজার্ভ ১৪০০ মার্কিন ডলার।
ধরূন, আমেরিকার কাছে ১,০০০ আউন্স স্বর্ণ আছে। অর্থাৎ সর্বোচ্চ ৩৫,০০০ মার্কিন ডলার সে স্বর্ণের বিনিময়ে ভাঙিয়ে দিতে পারবে।
হঠাৎ ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হল।
এই যুদ্ধে অস্ত্রসস্ত্র বানানোর জন্য আমেরিকা ১ লাখ মার্কিন ডলার ইমিডিয়েট দরকার।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক তথা আমেরিকার সেন্ট্রাল ব্যাংক-এর চেয়ারম্যানকে ফোন করে বলে দিলো ১ লাখ মার্কিন ডলার ছাপাতে এবং উনারা প্রিন্টিং প্রেস চালিয়ে ফটাফট ডলার ছাপিয়ে দিলো।
এখন ১০ লাখ ডলার দিয়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে লোহা, তামা, দস্তা, নিকেল, ইস্পাত, এটা সেটা কিনে যুদ্ধের অস্ত্রসস্ত্র বানালো আমেরিকা।
ফ্রান্স ওই ১০ লাখ ডলার পেমেন্ট আকারে নিলো এবং রিজার্ভ হিসেবে রাখলো আমেরিকাতে।
সে প্রেক্ষিতে, ফ্রান্সের ফরেন রিজার্ভ এখন বেড়ে দাড়ালো ১ লাখ + আগের ১৪০০ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ ফ্রান্সের এখন মোট ফরেন রিজার্ভ দাঁড়ালো ১,০১,৪০০ মার্কিন ডলার।
সমস্যা হল, আগেই বলেছি আমেরিকার কাছে তো স্বর্ণ আছে ৩৫,০০০ হাজার মার্কিন ডলারের সম পরিমাণ।
তো এখন যদি ফ্রান্স ১,০১,৪০০ মার্কিন ডলার ভাঙিয়ে নিতে চায়, তখন স্বর্ণ পাবে কই? স্বর্ণ তো নেই।
পরিস্থিতিটা বুঝতে পারতেছেন?
ঠিক এমন পরিস্থিতি হোক, সেটা কিন্তু ফ্রান্স চাইবে না। কারণ লস কিন্ত ফ্রান্সের।
ফ্রান্স ডলার ভাঙিয়ে স্বর্ণ নিয়ে অন্য যেকোনো দেশকে পেমেন্ট করতে পারবে। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নকেও পেমেন্ট করতে পারবে।
স্বর্ণ ন্যাচারাল মেটাল।
এটার সাপ্লাই কম। ইচ্ছে হলেই ডলার ছাপানো সম্ভব। স্বর্ণ নয়।
একটি দেশ আজ আছে কাল নেই। দেশ না থাকলে সে দেশের মুদ্রাও মূল্যহীন।
আজকে কারো হাতে ১ লাখ মার্কিন ডলার থাকতে পারে। এই ১ লাখ মার্কিন ডলার হাতে নিয়ে যদি টাইম মেশিনে করে ৩০০ বছর অতীতে চলে যান, তাহলে ওই ১ লাখ মার্কিন ডলারের কোনো ভ্যালু নাই।
৩০০ বছর আগে তো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নামক দেশেরই অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু স্বর্ণ? আপনি স্বর্ণ হাতে নিয়ে টাইম মেশিনে করে ১০০০ বছর পেছনে গেলেও মূল্য পাবেন।
টপিক্সে ফিরে আসি।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট Charles de Gaulle শুরু থেকেই ব্রেটন উডস এগ্রিমেন্ট পছন্দ করতেন না।
১৯৬০-এর দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধ যখন শুরু হল,
তিনি আশঙ্কা করলেন আমেরিকা যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহ করার জন্য ইচ্ছামত ডলার ছাপাচ্ছে। কারণ ডলার ইউনিভার্সেল কারেন্সি হওয়াতে এবং সকল দেশগুলো আমেরিকাতে মার্কিন ডলারে রিজার্ভ রাখাতে আমেরিকা আনফেয়ার এডভান্টেজ পাচ্ছে। ঠিক উপরের উদাহরণের মত।
সে সাথে, ফেডারেল রিজার্ভের ভল্টে বাস্তবে কত স্বর্ণ মজুদ আছে, সেটা নিয়েও আশঙ্কা ছিল তার।
তো ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এবং তার finance minister, Valéry Giscard d'Estaing সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ফ্রান্সের ফরেন মার্কিন ডলার রিজার্ভের বড় একটি অংশ স্বর্ণতে কনভার্ট করে ফেলার।
ফ্রান্স যখন এই কাজ শুরু করে, তখন মার্কিন গোল্ড রিজার্ভে চাপ পড়ে। ব্যস, যা হবার সেটাই হল।
১৯৭১ সালের ১৫ই আগস্ট, এলো Nixon Shock !
৩৫ ডলারের বিনিময়ে ১ আউন্স স্বর্ণের যে হিসাব কিতাব, তা বাতিল করে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।
শেষ হয়ে গেল ব্রেটন উডস সিস্টেম।
তত দিনে দুনিয়ার বহু দেশ ফরেন রিজার্ভ রাখতে শুরু করেছে মার্কিন ডলারে।
গোটা বিশ্বের ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেম চালিত হচ্ছে মার্কিন ডলারে। সামরিক, অর্থনৈতিক, ও প্রযুক্তিগতভাবে মার্কিনীরা ততদিনে সুপারপাওয়ার।
এবং মার্কিন ডলার ইউনিভার্সেল কারেন্সি।
মার্কিন ডলারকে সবাই বিশ্বাস করে।
আপনি যে দেশেই যান, ডলার সাথে করে যাচ্ছেন। যে দেশেই যাবেন, ডলারের ভ্যালু পাবেন। ভাঙ্গাতে পারবেন। VISA আর MasterCard দিয়ে কেনাকাটা করতেছেন। ডলারে পেমেন্ট করতেছেন।
পৃথিবীর সব দেশেই ডলার গ্রহনযোগ্য, এবং গোটা দুনিয়ার ব্যবসা বানিজ্য লেনদেন ততদিনে চলতেছে ডলারে।
সে সাথে ততদিনে সৌদি আরবের সাথে মার্কিনীরা ডিল করে ফেলেছে। সৌদি তেল বিক্রি হচ্ছে ডলারে। চলতেছে পেট্রো ডলারের রাজত্ব।
পরবর্তী পর্বে লিখবো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশগুলোর উঠে দাঁড়ানোর কাহিনী। আর তার পেছনে থাকা আমেরিকার মার্শাল প্ল্যান।
এছাড়াও লিখবো চলমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কিভাবে বিভিন্ন দেশ চেষ্টা করতেছে মার্কিন ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর। যেমন ব্রিকস-এর মত সংগঠন চাচ্ছে আবার গোল্ড ব্যাকড কারেন্সি ফিরিয়ে আনতে।
অন্যদিকে আমেরিকার ডলারকে কেউ উপেক্ষা করবে, এটা আমেরিকা সহ্য করতে পারবে না। গাদ্দাফি বা সাদ্দাম, যারা যখনই চেষ্টা করে ডলার ব্যতিত অন্যকোনো মুদ্রা বা স্বর্ণে তেল বিক্রি করতে, ব্যস, তখনই তাদের শেষ করে দিয়েছে।
অন্যসব দেশ যদি ডলার ইগনোর করে ভিন্ন ব্যবস্থাপনায় লেনদেন শুরু করে, তাহলে ডলারের বিশ্বব্যাপী ডিমান্ড যাবে কমে। ডিমান্ড কমে গেলে মূল্য হারাবে ডলার। আর তা হবে মার্কিন অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক।
ডলারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানে আমেরিকার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। Gold Backed Currency থেকে Fiat Currency-এর এই অধ্যায় নিয়ে লিখবো সামনে।
আজ একেবারে সিম্পল ওয়েতে, একেবারে Basic লেভেলে লিখলাম। বাস্তবে অবশ্যই সবকিছু আরো অনেক জটিল ছিল। সামনে আরো লিখবো।

No comments:

Post a Comment

Note: Only a member of this blog may post a comment.