Monday, September 11, 2017

মেক্সিকান আন্ডারওয়ার্ল্ড


তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিলো মেক্সিকোর সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্বলিত মিলিটারি নিয়ন্ত্রিত জেলখানায়। তাঁর থাকার সেলটিও সর্বক্ষণ সিসি ক্যামেরা দ্বারা পর্যবেক্ষণে রাখা হত।
একদিন সিসি ক্যামেরায় দেখা গেল, তিনি গোসল করার জন্য shower room গেলেন। ব্যস, এরপর ঠিক ম্যাজিসিয়ানের মত, গায়েব !

বলছিলাম, CEO of Crime হিসেবে পরিচিত, এল চ্যাপো গুজম্যানের কথা।
কিভাবে সেদিন ওই গোসলখানা থেকে তিনি গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন, শুনলে অবাক হবেন।

সেই গোসল খানার ঠিক নিচে এক মাইল লম্বা ট্যানেল নির্মান করেছিলো এল চ্যাপোর লোকেরা। রীতিমত আন্ডারগ্রাউন্ড রেলওয়ে লাইনের মত ট্যানেল।

এই সেই গোসলখানা।


আর এই সেই ট্যানেলের অন্যপ্রান্তের মুখ।


আর নিচের ছবিতে দেখতেছেন ট্যানেলের ডিজাইন।


এতো দীর্ঘপথ যাতে এল চ্যাপোকে পায়ে হেটে যেতে না হয়, সেজন্য রেল লাইন বসিয়ে তাতে আবার মোটরসাইকেল ইম্প্রোভাইজ করে বিশেষ vehicle বানিয়ে এল চ্যাপোকে জেল থেকে বের করে আনা হয়েছিল।




এতো দীর্ঘ টানেলের ভেতরে ইলেকট্রিসিটি ও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উপরে ট্যানেলের নকশাটি দেখতে পাচ্ছেন।
রীতিমত প্রোফেশন্যাল লেভেলের কাজ।
প্রায় এক মাইলের বেশি দুরে গিয়ে ট্যানেলের অন্যপ্রান্ত থেকে বের হয়ে আসেন এল চ্যাপো।

গোটা ব্যাপারটা কোনো হলিউডি মুভিকে হার মানাবে।

যে ব্যক্তির কথা বলছি, সেই "El Chapo" Guzmán মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যমতে "the most powerful drug trafficker in the world"

গোটা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে বিখ্যাত Forbes ম্যাগাজিন।
তাতে বারাক ওবামা, ভ্লাদিমির পুতিনের মত বিশ্ব নেতারা থাকেন।

আর ২০০৯, ২০১০ এবং ২০১১ সালের দিকে এল চ্যাপো ছিল যথাক্রমে ৪১, ৬০ এবং ৫৫ নাম্বারে !
মেক্সিকোর টেলিকম ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিমের পর তিনিই ছিলেন মেক্সিকোর সবচেয়ে পাওয়ারফুল ব্যক্তি।
(DEA)- এর তথ্য মতে, তিনি “The most ruthless, dangerous, and feared man on the planet”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের Crime Commission ২০১৩ সালে
"the godfather of the drug world" হিসেবে পরিচিত এল চ্যাপোকে ঘোষণা করেছিলো "Public Enemy Number One" হিসেবে।

এল চ্যাপো গুজম্যান মেক্সিকোর নাগরিক।
Gangland হিসেবে পরিচিত মেক্সিকোর অন্যতম পাওয়ারফুল গ্যাং সিনোলোয়া কার্টেলের প্রধান।

বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন মেক্সিকোকে টার্গেট করে। “they are bringing drugs.. they are bringing crimes… they are rapists… and some of them are good people”

এই কথাটি বলে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতেই সমালোচিত হয়েছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমস্যা হল, যে কথাটা ভদ্রভাষায় বলা যায়, সেই কথাটাকেও সে সরলীকরণ করে একেবারে বাজেভাবে বলে।
তবে আমেরিকাতে ড্রাগসের সমস্যা যে ভয়াবহ, সেটা জানার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের দরকার নেই। তথ্য উপাত্ত দেখলেই চলে।
কিছু তথ্য উপাত্ত দেয়া যাক। খোদ মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য উপাত্ত দেখলেই ভয়াবহ অবস্থাটা কিছুটা হলেও বোঝা যায়।

মার্কিন কংগ্রেসের গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, Mexican drug cartels take in between $19 and $29 billion annually from US drug sales.

কেবল মেক্সিকোর ড্রাগ কার্টেলগুলোই যদি বছরে ১৯ থেকে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ড্রাগসের সাপ্লাই আমেরিকাতে দেয়, তাহলে ভেবে দেখুন আসল চিত্র আরো কত ভয়াবহ।

আমেরিকাতে ঢোকা ৯০% কোকেন মেক্সিকোর বর্ডার হয়েই আসে। আর এই কোকেন উৎপাদন হয় মুলত পেরু, কলম্বিয়া আর বলিভিয়াতে।
কলম্বিয়ান মাফিয়ারা মেনুফ্যাকচারিং বা প্রোডাকশন নিয়ন্ত্রন করে। আর মেক্সিকান মাফিয়া সাপ্লাই চেইনের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রন করে। মুল গন্তব্য কিন্তু সেই আমেরিকা।
পাবলো এস্কোবার বা কালি কার্টেলদের জামানায় মেক্সিকোকে বলা হত বাউন্সিং ট্রেম্পোলিন। অর্থাৎ দক্ষিন আমেরিকা থেকে উৎপাদিত ড্রাগ মেক্সিকো নামক ট্রেম্পোলিনের উপর একটা লাফ দিয়ে আমেরিকাতে চলে যেত। কথাটা মেটাফোরিক। কি বোঝানো হচ্ছে, আশা করি সবাই বুঝতে পারতেছেন।
যেমন, কেবল ২০১০ সালেই ৪০০ মেট্রেক টন কোকেন মেক্সিকোর বর্ডার হয়ে আমেরিকাতে ঢুকেছে।

কোকেনের মুল সাপ্লাই দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশীয় দেশগুলো থেকে এলেও,
আমেরিকাতে ঢোকা হেরোইন আসে মুলত মধ্যএশিয়া ও এশিয়া থেকে।
৯০% ওপিয়াম উৎপাদন হয় আফগানিস্তানে। এখানে প্রোডাকশন নিয়ন্ত্রন করে এশিয়ান মাফিয়াগুলো। আর তাঁদের সাথে যুক্ত হয়ে ল্যাটিনো ও আমেরিকান মাফিয়াগুলো সাপ্লাই ও ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ন্ত্রন করে।
গাজা আমেরিকার কিছুকিছু স্টেটে লিগালাইজ হয়েছে। কিন্তু এখনো মেক্সিকো থেকেই গাজার সিংহভাগ সাপ্লাই আমেরিকাতে আসে।
জাতিসংঘের তথ্য মত বার্ষিক ড্রাগ ট্রেডের পরিমাণ হাফ ট্রিলিয়ন ডলারের সমান। মেক্সিকোতে তৈরি হওয়া মেথানফেটামিনের জন্য দরকারি কেমিক্যালস আসে চীন থেকে। অর্থাৎ ইয়াবা বা মেথ। যেটাই বলি।
সেই সুত্র মেক্সিকান মাফিয়াদের সাথে চাইনিজ ও জাপানিজ সহ এশিয়ান মাফিয়াদের লিঙ্ক তৈরি হয়েছে অনেক আগে থেকেই।

According to a 2007 United Nations report, স্পেনে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভেতর প্রতি ১০০ জনের ৩ জন, অর্থাৎ ৩% মানুষ কোকেন আসক্ত। যা দুনিয়াতে সর্বোচ্চ। আর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। (২.৮%)
তবে দেশ হিসেবে মোট সেবনের পরিমাণ বিচার করলে আমেরিকা সর্বোচ্চ।
২০০০ সালে গোটা পৃথিবীতে কোকেন সেবনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০০ টন। যার ৩০০ টন কনজিউম করেছে আমেরিকা একাই। অর্থাৎ ৫০%
The 2010 UN World Drug Report concluded that "it appears that the North American cocaine market has declined in value from US$47 billion in 1998 to US$38 billion in 2008. Between 2006 and 2008, the value of the market remained basically stable.
http://www.unodc.org/pdf/research/wdr07/WDR_2007.pdf


গাঁজার পর কোকেনই আমেরিকার মাদকসেবীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ। এবং একক দেশ হিসেবে আমেরিকাতে সবচেয়ে বেশি কোকেনের সেবন হয়। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের ভেতর কোকেন জনপ্রিয় হবার কারণে এটাকে "rich man's drug" বলা হয়ে থাকে।

কলেজ পড়ুয়া মার্কিনী ছেলেমেয়েদের কাছেও কোকেন সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্টি ড্রাগস হিসেবে। . A study throughout the entire United States has reported that around 48 % people who graduated high school in 1979 have used Cocaine recreationally during some point in their lifetime,
the drug became particularly popular in the disco culture as cocaine usage was very common and popular in many discos such as Studio 54.


২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোকেনের মোট বাজার ছিল ৭০ বিলিয়ন ডলারের। যা সেই বছর Starbucks টাইপের বিখ্যাত কর্পোরেশনের বার্ষিক রেভিনিউয়ের চেয়ে বেশি ছিল।


২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ওপিয়াম উৎপাদনের ৬৬% হয়েছে কেবল এক আফগানিস্তানে।
According to a U.N. sponsored survey, in 2004, Afghanistan accounted for production of 87 percent of the world's diamorphine.
Afghan opium kills around 100,000 people annually.

According to the 2012 National Survey on Drug Use and Health (NSDUH), আমেরিকাতে কেবল ইয়াবা বা মেথ আসক্ত মানুষ আছে ১ কোটি ২০ লাখ।
এটাও মাথায় রাখুন, আমেরিকার জনসংখ্যা ৩১ কোটির বেশি।

আমাদের বাংলাদেশেও প্রতিমাসে লক্ষ লক্ষ পিচ ইয়াবা প্রবেশ করে কেবল পার্বত্য চট্রগ্রাম দিয়েই। লক্ষ লক্ষ পিচ ইয়াবা পুলিশ আটক করে।
আমাদের দেশও এদিক দিয়ে খুব একটা পিছিয়ে আছে কি?
পুলিশের হাতে যা ধরা পড়ে, সেটা খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ।

যেখানে ডিমান্ড থাকবে, সেখানে সাপ্লাই আসবেই। এটা ঠেকানোটা দুরুহ ব্যাপার। সেই পাবলো এস্কোবারের যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আমেরিকার DEA কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু লাভ কি?
ল্যাটিন আমেরিকার ড্রাগ ট্র্যাফিকারদের ধরতে আমেরিকা গত পঞ্চাশ বছরে যে পরিমাণ অর্থ ও সময় ব্যয় করেছে, তাতে লাভ হয়েছে কি?
তেমন কোনো লাভ হয়নি।
পাবলো এস্কোবার মরেছে। তাঁর জায়গায় ক্যালি কার্টেল এসেছে। ক্যালি কার্টেলকে ধরা হয়েছে। তাঁদের জায়গায় মেক্সিকান মাফিয়ারা এসেছে। এল চ্যাপো গুজম্যানকে ধরা হল, এবার তাঁর জায়গায় অন্যকেউ আসবে।
এই যুদ্ধ চলবেই।
অথচ এই অর্থ, এই সময়, এই শ্রম যদি আমেরিকা নিজের দেশে মাদকসেবন রোধ করতে ব্যয় করতো, সামাজিক আন্দোলন চালিয়ে নিজ দেশে মাদকসেবন প্রতিহত করার চেষ্টা করতো, তাহলে হয়ত আরো বেশি সফলতা আসতো।


এটি ২০১০ সালে মেক্সিকোতে ড্রাগ কার্টেলগুলোর নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর ম্যাপ...
ড্রাগ কার্টেলগুলোর ভেতর সর্বক্ষণ টেরিটোরিয়াল ক্ল্যাস চলে। এবং তাতে মারা যায় হাজারহাজার মানুষ।
মেক্সিকো ড্রাগ কার্টেলগুলোর জন্য রীতিমত রণক্ষেত্র।
যেমন উপরের মানচিত্রে (২০১০ সালের) আকাশী রঙের যে টেরিটোরি দেখছেন, সেটা ছিল সিনালোয়া কার্টেলের নিয়ন্ত্রণে।
সবচেয়ে পাওয়ারফুল এই সিন্যালোয়া কার্টেলের প্রধান হল এল চ্যাপো গুজম্যান।

মেক্সিকোর সাথে আমেরিকার যে বিশাল বর্ডার আছে, এই বর্ডার দিয়ে আনায়াসে ড্রাগ প্রবেশ করে। বিশেষ করে আমেরিকার নিউ মেক্সিকো এবং এরিজোনা বর্ডার এরিয়াতে বিশাল বিশাল ট্যানেল বানিয়ে এসব ট্যানেল দিয়ে টনকে টন মাদকদ্রব্য প্রবেশ করানো হয়।
মার্কিন বর্ডার গার্ডেরা মাঝেমাঝেই বড়বড় ট্যানেলের সন্ধান পায়। এবং সেসব ট্যানেল ধ্বংসও করা হয়। কিন্তু ট্যানেল নির্মান চলতে থাকে। এবং ড্রাগসও আমেরিকাতে প্রবেশ করতেই থাকে।
এল চ্যাপোর সিনালোয়া কার্টেলে এক বড়সড় ইঞ্জিনিয়ারিং টিম আছে, ট্যানেল এক্সপার্ট আছে, যারা রীতিমত প্রফেশন্যাল স্কিলে এসব ট্যানেল নির্মান করে।

যেমন নিচের চিত্রে ২০০৭ সালে মার্কিন বর্ডার গার্ড’দের সিজ করা একটা ট্যানেল দেখতে পাচ্ছেন। অন্তত ধারণা পাবেন, কিভাবে ট্যানেলগুলো মেক্সিকান ড্রাগ কার্টেল ব্যবহার করে।







নানান উপায়ে আমেরিকাতে প্রবেশ করানোর পর এসব ড্রাগস ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় আমেরিকা জুড়ে। আমেরিকাতে থাকা ডিস্ট্রিবিউটরদের সাহায্যে।



যেমন উপরের মানচিত্রে দেখতেই পাচ্ছেন, আমেরিকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের অধিকাংশ জায়গায় প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে সিনালোয়া কার্টেল। (deep yellow color)

আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন লোকেশনগুলো হল ম্যায়ামি, নিউইয়র্ক, লাস ভেগ্যাস, লস এঞ্জেলস, এবং অবশ্যই শিকাগো।
শিকাগো শহর অবশ্য অনেক আগে থেকেই আমেরিকান মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য ছিল। এই শিকাগোতে রাজত্ব করতো আল ক্যাপোনের মত ইতিহাসের অন্যতম আলোচিত মাফিয়া ডন।

আর এখন এই শিকাগো শহরে সবচেয়ে বেশি মেক্সিকান হিস্পানিক মানুষের বসবাস। আর এসব হিস্পানিক কমিউনিটির ভেতর ঘাপটি মেরে থাকে MS-13 এর মত দুর্ধর্ষ গ্যাং...
এল চ্যাপোর সিনালোয়া কার্টেলের সাথে সরাসরি সম্পর্ক আছে MS-13 এর। MS-13 এর মুল ট্যারিটোরি অবশ্য ক্যালিফোর্নিয়াতে।
শিকাগো শহর দাপিয়ে বেড়ায় Latin kings, Gangster Disciples, Latin Angels, Los Zetas, Chicago outfits
টাইপের ডজনখানেক গ্যাং।
এসব গ্যাংগুলো টেরিটোরি নিয়ে নিজেরা নিজেরা মারামারি খুনোখুনি করে। ফলাফল, শিকাগো শহরের ক্রাইমরেট রীতিমত ভয়াবহ। খোদ মার্কিন রাজনীতিবিদেরাও শিকাগো শহরের ক্রাইম প্রবলেম নিয়ে অনেক চিল্লাপাল্লা করে এসেছে।
Chicago is considered the most gang infested city in the United States, with a population of over 100,000 active members from nearly 60 different factions.
Gang warfare and retaliation is common in Chicago. Gangs were responsible for 61% of the homicides in Chicago in 2011. (from Wikipedia)

August 2016 marked the most violent month Chicago had recorded in over two decades with 92 murders,
By October 2016, Chicago had surpassed 600 homicides and over 2,800 people shot, marking a 32 percent increase in murders and non-fatal shootings compared to 2015.
Chicago's 2016 murder and shooting surge has attracted national media attention from CNN, The New York Times, USA Today, Time Magazine and PBS.


আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব গ্যাংগুলোর মুল ব্যবসা হল ড্রাগস। মেক্সিকান মাফিয়াদের সাথে এরা ব্যবসা করে। মেক্সিকান মাফিয়ারা কলম্বিয়া থেকে কোকেনের মত ড্রাগস প্রতি কেজি ২ হাজার ডলার মুল্যে কিনে নিয়ে আসে। এরপর সেটা বর্ডার পার করে আমেরিকাতে থাকা এসব গ্যাংগুলোর কাছে প্রতি কেজি ৩০ হাজার ডলার মুল্যে বিক্রি করে। এরপর সেই কোকেন আমেরিকাতে কেজি প্রতি ১ লাখ ডলার মুল্যে বিক্রি হয়।
বুঝতেই পারতেছেন, বিশাল ব্যবসা।
চেইন বিজনেস।

ক্যালিফোর্নিয়া, নিউইয়র্ক, ম্যায়ামি, লস এঞ্জেলস, লাস ভেগাসের মত জায়গায় ড্রাগসের দাম বেশি। সেখানে পয়সাওয়ালা মানুষও বেশি। কমন ইকুয়েশন। সুতরাং এসব এলাকার টেরিটোরি দখল করা নিয়ে গ্যাংগুলোর ভেতর মারামারিও বেশি হয়।

এল চ্যাপো গুজম্যানের জন্ম ১৯৫৭ সালে। তাঁর জন্ম সিনালোয়া প্রদেশে।
এই রিজিওনে গ্রামীন এলাকার প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে গাঁজার চাষ করে। গন্তব্য আবার সেই আমেরিকা।
অর্থাৎ আমেরিকাতে গাঁজা চাষ যেহেতু অবৈধ ছিল, (এখনো আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যে অবৈধ) সেহেতু এসব মেক্সিকোর গ্রামীণ জনপদে গাঁজার চাষ হয়, এবং এই গাঁজা মেক্সিকান ড্রাগ ট্রাফিকাররা আমেরিকাতে এক্সপোর্ট করে।
সনাতনী ফসল চাষ করার চেয়ে কৃষকদের কাছে গাঁজা চাষ অনেক বেশি লাভজনক।
এটা অবশ্য আমাদের দেশেও একটু অন্যভাবে দেখা যাচ্ছে। যেমন হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানে কিছুদিন আগে একটি প্রতিবেদন দেখিয়েছিল। দেশের উত্তরবঙ্গে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো টাইপের বিদেশি বিড়ি সিগারেট কোম্পানিগুলো মোটা অংকের টাকা দিয়ে কৃষকদের তামাক চাষে উৎসাহিত করতেছে। কৃষকরাও দ্রুত লোভের আশায় ফসলী জমিতে তামাক চাষ করতেছে। তামাক গাছ চাষ করতে গিয়ে কেবল মাটি না, জমির পাশে পুকুর, খাল বিলও বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। মাটির অবস্থা এমন হচ্ছে, ভবিষ্যতে এই মাটিতে আর কোনো ফসল ফলানো সম্ভব না, কেবল তামাক ছাড়া...

তো মেক্সিকোতে চলতেছে গাঁজা চাষ।
এল চ্যাপো গুজম্যানের পরিবার এই গাঁজা চাষের সাথেই যুক্ত ছিল।
ফলে ড্রাগ ট্রাফিকারদের সাথে তাঁর পরিচয় হতে বেশি সময় লাগেনি।
এল চ্যাপোর বাবা সারাদিন মদ গাঁজা খেতো এবং পতিতালয়ে গিয়ে সময় কাটাতো। ফলে কম বয়সেই গাঁজা চাষাবাদের কাজে এল চ্যাপোকে মনযোগ দিতে হয়। লিখাপড়া আর করা হয়ে ওঠেনি।
সময় যেতে থাকে। এল চ্যাপো উঠাবসা করতে শুরু করে ড্রাগ ট্রাফিকারদের সাথে। ধীরেধীরে ওই অঞ্চলের বড়বড় ড্রাগ ট্রাফিকার হর্তাকর্তাদের সাথে এল চ্যাপোর পরিচয় হয়।
এরপর যা হবার সেটাই... অর্থাৎ একেএকে ওদেরকে খুন করে বা সরিয়ে দিয়ে একসময় এল চ্যাপো গ্যাংলিডার হয়ে যায়।




এবার কিছু ব্যাপার মাথার রাখতে বলবো। মেক্সিকোর পরিস্থিত আপনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আশি ও নব্বয়ের দশকে মেক্সিকোর অবস্থা খুব খারাপ ছিল। এখনো খুব একটা ভালো না। সিনোলোয়ার মত এলাকাগুলোর অধিকাংশ জায়গা অনুন্নত। গরিব মানুষ আছে প্রচুর। বেকারত্ব সমস্যা আছে ভয়াবহ। তো দেখা যায়, ড্রাগসের বিজনেসের সাথে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে গিয়েছে প্রচুর মানুষজন। ড্রাগস উৎপাদন করে আমেরিকাতে রফতানি করা হচ্ছে। সুতরাং ডলার রিটার্ন আসতেছে। সিনালোয়ার মত এলাকাতে এল চ্যাপোর ইমেজ একারণে রীতিমত রবিন হুডের মত।
পুলিশ প্রশাসন এল চ্যাপোর পে রোলে থাকে। রাজার হালে চলে সে। দুইশো দেহরক্ষী তাঁর নিরাপত্তা দেয়।
সেইসাথে সিনোলোয়া কার্টেলের আছে বিশাল ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক। রীতিমত প্রফেশন্যাল লেভেলের। যারা Netflix এর Narcos সিরিয়াল দেখেছেন, আমি কি বলতেছি, সেটা হয়ত তাঁরা আরো ভালো বুঝতে পারবেন।
আমেরিকা থেকে fusion চ্যানেলের কিছু সাংবাদিক গিয়েছিলো এল চ্যাপোর সিনোলোয়া প্রবেশে। এল চ্যাপোর উপর প্রতিবেদন বানাতে।
বিমানবন্দরে নামার সাথেসাথে এল চ্যাপোর লোকেরা তাঁদের ফলো করা শুরু করে। এবং তাঁদের প্রতিটি মুভমেন্ট ফলো করা হয়।
পলিটিয়ান থেকে শুরু করে সরকারি হর্তাকর্তা আমলাদেরও অনেকে থাকে এল চ্যাপোর পে রোলে...
টাকা থাকলে ক্ষমতা কেনা যায়... আবার ক্ষমতা থাকলে টাকা আসে...

রীতিমত গোয়েন্দাবাহিনী বানিয়ে ফেলেছে এসব কার্টেলগুলো। তাঁদের নিজনিজ টেরিটোরি ও তাঁদের ব্যাক্তিগত নিরাপত্তার স্বার্থে।
এবং ব্যাপক মানুষের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাতে এলাকাতেও তাঁরা জনপ্রিয়।
যেমন এল চ্যাপো গুজম্যানকে তাঁর এলাকায় রীতিমত প্রভুভক্তি করা হয়। সে রীতিমত সেলিব্রিটি। আর সেইসাথে যেহেতু সে আমেরিকার শত্রু, সেহেতু তাঁর প্রতি আলাদা সফট কর্নার আছে মেক্সিকোবাসীর। কারণ এসব ল্যাটিন দেশের অনেক দুর্দশার জন্য এরা আমেরিকাকে দায়ী করে এবং এসব দেশের মানুষের ভেতর এন্টি আমেরিকান সেন্টিমেন্ট আছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণে।



এল চ্যাপো এই রিজিওনে রীতিমত সেলিব্রিটি। তাঁর নামে ক্যাপ, টি শার্ট বিক্রি হয়।



যেমন, নিচে ছবি’তে দেখছেন, সিনোলোয়া এলাকাতে একটা চার্চ



খেয়াল করে দেখুন, জিসাস ও মাদার মেরীর মুর্তির সামনে যে মোচওয়ালা মুর্তি আছে, এই ভদ্রলোকের নাম Joaquin Murrieta
তাঁকে মেক্সিকোর রবীনহুড বলা হয়। The Real Zorro (দেখতেই তো পারছেন, চার্চের দেয়ালে রীতিমত মার্কিন ডলার লাগিয়ে রেখেছে)
তাঁকে রীতিমত পুজা করা হয়।

সিনালোয়াতে এল চ্যাপোর ইমেজ হল আধুনিক যুগের Joaquin Murrieta, যে গরিব মানুষের জন্য কাজের ব্যবস্থা করেছে, ডলার নিয়ে এসেছে।



রাইভেল গ্যাংদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে এল চ্যাপো ১৯৯৩ সালে জেলে গিয়েছিল। অবশ্য এই জেলে যাওয়াটা কিছুটা তাঁর ইচ্ছাতেই হয়েছিল। তাঁর মত লোকের জন্য জেলখানা মাঝেমাঝে বেশ নিরাপদ জায়গা।
এল চ্যাপো জেলখানাকে রীতিমত ফাইভ স্টার হোটেল বানিয়ে ফেলেছিলো। জেলখানার নিরাপত্তা প্রহরী অনেকেই ছিল এল চ্যাপোর পে রোলে।
টাকা থাকলে সব জায়গাতেই সিস্টেম করা যায়।
জেলখানাতে মডেল থেকে শুরু করে প্রস্টিটিউটদের রাতদিন আনাগোনা চলতো। জেলখানার কয়েদী অনেকেই ছিল এল চ্যাপোর লোকজন। সেখানে আবার অন্য রাইভেল গ্যাংদের লোকেরাও ছিল। তাঁদের সাথে মারামারিও বেধে যেত।

Zulema Hernandez নামের এক মহিলার সাথে প্রেম হয়ে যায় এল চ্যাপোর এই জেলখানায় বসে।
এই জেলখানাতে বসেই এল চ্যাপোর বিজনেস ছড়িয়ে পড়ে মেক্সিকো থেকে স্পেন। স্পেন হয়ে ইউরোপে।

২০০১ সালে পরিস্থিত বদলে গেলে জেলখানা থেকে একরকম পায়ে হেটে বেরিয়ে যান এল চ্যাপো।
এরপর এল চ্যাপো রাইভেল গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এই যুদ্ধ আজ পর্যন্ত চলতেছে। লক্ষাধিক লোক নিহত হয় এই ড্রাগ যুদ্ধে।
কেবল ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৬০ হাজার মানুষ মারা গেছে ড্রাগ ট্রাফিকারদের ভেতর ইন্টারনাল যুদ্ধে।
Beltrán Leyva Cartel ছিল এল চ্যাপোর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
ওদিকে মেক্সিকান সরকারি আর্মি এবং আমেরিকার DEA এক হয়ে এল চ্যাপোর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে।

অনুমানিক, কমপক্ষে ৪ বার বৈধভাবে বিয়ে করেছেন এল চ্যাপো। সন্তান আছে কমপক্ষে দশজন।
২০০৭ সালে সর্বশেষ বৈধভাবে বিয়ে করেন একজন মার্কিনী মডেলকে। নাম Emma Coronel Aispuro



২০১২ সালে আমেরিকার মাটিতে তাঁদের জমজ সন্তানের জন্ম হয়।
এটা বলা বাহুল্য যে নিরাপত্তাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়েই এল চ্যাপো দেশে দেশে ঘুরতো...

২০১৪ সালে এল চ্যাপো আবার গ্রেফতার হয়। এবার আর নাম’কা ওয়াস্তে গ্রেফতার নয়। এবার সিরিয়াস।
মিলিটারি গ্রেডের জেলখানায় রাখা হয় এল চ্যাপোকে।
সেখানথেকেই সেই টানেল বানিয়ে পালিয়ে যায় এল চ্যাপো। যেটা নিয়ে শুরুতেই বললাম।
২০১৫ সালে।

ঠিক সেইবছরই নির্বাচনী প্রচারণায় নামে ডোনাল্ড জে ট্রাম্প।
আর নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেই মেক্সিকো’ এবং ড্রাগস ইস্যুকে হাইলাইট করে প্রচারণা শুরু করে ট্রাম্প।
এল চ্যাপো ট্রাম্পের মাথার মুল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করে। জি হা... ঠিকই শুনেছেন। ট্রাম্পের মাথার মুল্য ১০০ মিলিয়ন ডলার ঘোষনা করেছিল এল চ্যাপো।

ড্রাগস ইস্যু যে কত বড় সমস্যা আমেরিকাতে, আমেরিকার প্রগতিশীল শিক্ষিত সমাজ সেটা নিয়ে এতোটা চিন্তিত না হলেও আমেরিকার আমজনতা এটাকে বেশ সিরিয়াসলি নিয়েছিল।
খেয়াল করে দেখবেন, ট্রাম্প যে বর্ডার দেয়াল বানানোর প্রপোজাল দিয়েছে, সেটা কিন্তু এই ড্রাগস এবং অবৈধ অধিবাসী প্রবেশ বন্ধ করার ধুয়া তুলে...
যদিও দেয়াল বানিয়ে কখনোই ড্রাগ ট্রাফিকারদের আটকানো পসিবল হবে কিনা, সেটা সন্দেহ।
কারণ তো এতোক্ষণ পড়লেনই।
এরা রীতিমত আন্ডারগ্রাউন্ডে বিশাল সাইজের টানেল বানিয়ে ড্রাগ প্রবেশ করাচ্ছে। দেয়াল বানিয়ে এদের কিভাবে আটকানো যাবে, সেটা আমার বোধগম্য না।


এরপর এল চ্যাপোকে তৃতীয়বারের মত গ্রেফতার করা হয়। ২০১৬ সালে।


এবার আর মেক্সিকোর কোনো জেলে রাখা হয়নি তাঁকে। আমেরিকা তাঁকে extradition এর মাধ্যমে ২০১৭ সালে এল চ্যাপোকে মেক্সিকো থেকে আমেরিকাতে নিয়ে আসা হয়। ১৯শে জানুয়ারি।

ঠিক তার একদিন পরই ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়।


বর্তমানে এল চ্যাপো আমেরিকাতে বন্দী আছে।
টেড ক্রুজ কিছুদিন আগে পরামর্শ দিয়েছিলেন, এল চ্যাপোর লুকানো ব্যাংক ব্যালান্স উদ্ধার করে সেই টাকা দিয়ে ট্রাম্পের বর্ডার দেয়াল বানাতে।
আমার ধারনা, এটা জাস্ট কথার কথা...

মেক্সিকোর প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ড্রাগ কার্টেলগুলোকে দমন করতে। সাফল্যের দেখা কিছু পেয়েছে। তবে ড্রাগ কার্টেলের বিশাল সম্রাজ্যে হয়ত কেবলমাত্র কিছু অংশতে আঘাত হানতে পেরেছে।
এল চ্যাপো না থাকলে তাঁর জায়গায় অন্যকেউ আসবে। অথবা রাইভেল গ্যাং এল চ্যাপোর ভ্যাক্যুয়াম দখল করবে। কিন্তু কার্টেলের রাজত্ব চলবেই। অন্তত যতদিন আমেরিকাতে ড্রাগসের বিশাল ডিমান্ড থাকবে, ততদিন।

কিছুদিন আগে মেক্সিকান সেনাবাহিনী ড্রাগসের একটা চালান জব্দ করেছিল। নিচে দেখছেন সেটার ছবি।



এছাড়া ড্রাগ ট্রাফিকারদের গ্রেফতারও করা হচ্ছে নানা সময়ে। তাঁদের টাকা পয়সাও জব্দ করা হচ্ছে।






এতোকিছুর পরও মেক্সিকোতে গাঁজা, পপি, মেথ উৎপাদন কমেনি। বরং বেড়েছে। গত দশ বছরে দিগুন হয়েছে। এল চ্যাপোর না থাকার পরও তাঁর সিনোলোয়া কার্টেল বহাল তবিয়তে চলতেছে।



এতো গেল কেবল ড্রাগস। কার্টেলদের বিজনেস কখনোই কেবলমাত্র ড্রাগসের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না। মানবপাচার, মানিলন্ডারিং, হুন্ডির ধান্দা, প্রস্টিটিউশন, অস্ত্রের ব্যবসা তাঁদের কাছে নতুন কিছু না। তবে একটা ভিন্ন ডাইমেনশন তাঁরা এনেছে গত বিশ বছরে।
সেটা হল তেল।

এবার বলতেছি মেক্সিকোর আরো একটি ভয়াবহ চিত্র।
ইরাক যুদ্ধের পর তেলের দাম বেড়ে গিয়েছিল ব্যাপকভাবে। আর মেক্সিকোর কার্টেলগুলোর চোখ পড়েছিল তখন তেলের দিকে।
ক্রুড ওয়েল, অর্থাৎ অপরিশোধিত তেল মেক্সিকোর সবচেয়ে বড় রফতানিখাত। এবং মেক্সিকোর তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা আবারও সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
মেক্সিকোর অর্থণীতির লাইফ ব্লাড বলা হল তেল।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব কোম্পানি Pemex এর কাছ থেকেই মেক্সিকো সরকার মোট রাজস্বের তিনভাগের একভাগে আদায় করে।
অথচ এই কোম্পানির তেলের পাইপলাইন কেটে তেল চুরি করাটাকে রীতিমত ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে মেক্সিকান মাফিয়ারা।

২০০০ সাল থেকে তেলের পাইপ লাইন কেটে তেল চুরি করার হার বেড়ে গিয়েছে ভয়াবহ ১৫৪৮%

মাল্টি মিলিয়ন ডলারের আন্ডারগ্রাউন্ড তেলের বাজার তৈরি করেছে মেক্সিকান মাফিয়ারা চুরি করা তেল বিক্রি করে।
ইন ফ্যাক্ট, রীতিমত মিলিটারি দিয়ে তেলের পাইপলাইনগুলোর নিরাপত্তা দিতে হচ্ছে মেক্সিকান সরকারকে।
মেক্সিকান সরকার রীতিমত দিশেহারা এই তেলচুরি ঠেকাতে গিয়ে।

ব্যবসাটা কি বুঝেছেন এখনো?
ধরূণ, মেক্সিকো থেকে একটা পাইপলাইনে করে তেল যাচ্ছে আমেরিকাতে। মেক্সিকো সরকার ব্যারেল প্রতি তেল বিক্রি করতেছে আন্তর্জাতিক বাজার মুল্যে। ধরূণ, ১০০ টাকা... অর্থাৎ কথার কথা, ১০০ টাকা দিয়ে মেক্সিকো আমেরিকার কাছে তেল বিক্রি করতেছে।

এখন ড্রাগ কার্টেলরা পাইপলাইন কেটে তেল চুরি করে সেই চুরি করা তেল ধরূণ ৫০ টাকায় আমেরিকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতেছে গোপনে। অর্থাৎ অর্ধেক দামে চুরি করা তেল ব্যারেলে ভরে টেক্সাসে পাচার করে দিচ্ছে, যেভাবে হেরোইন, কোকেইন পাচার করে, সেভাবে।
আমেরিকান ছোটছোট তেলের ডিপোর মালিকদের এতে লাভ। তাঁরা ৫০ টাকা দিয়ে তেল কিনে ১২০ টাকার বিক্রি করতেছে। যেখানে ১০০ টাকায় লিগ্যালি কিনে ১২০ টাকায় বিক্রি করার কথা।
অর্থাৎ হিসাবটা নিশ্চয় বুঝেছেন। আমেরিকার তেলের পাম্প বা ডিপোগুলোর মালিকেরা বেশি লাভ করতেছে চুরি করা তেল কিনে।

টেক্সাসের পাঁচটি কোম্পানিকে ইতিমধ্যেই সনাক্ত করা হয়েছে চুরি করা তেল কেনার দায়ে। valley fuel ltd, Murphy Energy Corp, Trammo petroleum, BASF Corp এবং US petroleum Deport সরাসরি চুরি করা তেল কেনার সাথে জড়িত।
আবার মেক্সিকান কার্টেলগুলোর তো সবটাই লাভ। চুরি করা তেল যত কম দামেই বিক্রি করুক, লোকসান অন্তত হবে না।



ছবিতে দেখতেছেন, কিভাবে মাটি খুড়ে তেলের পাইপ লাইন ফুটা করে ছোট পাইপ লাগিয়ে তেলে টেনে চুরি করা হচ্ছে।

কার্টেলরা এটাকে বলে Fuel milking

মেক্সিকোতে মোট ১৭ হাজার মাইল তেলের পাইপলাইন আছে। এতো বিশাল পাইপলাইন নেটওয়ার্ক সারাক্ষণ সামাল দিয়ে রাখাটা রীতিমত অসম্ভব।
আর এজন্য তেল চুরিও ঠেকানো যাচ্ছে না।
সেইসাথে পেমেক্স কোম্পানির অসাধু কর্মচারী ও ঠিকাদারেরাও জড়িত আছে। জড়িত আছে অসাধু কর্মকর্তারা। গত দশ বছরে শতাধিক পেমেক্স কর্মকর্তা কর্মচারীকে তেল চুরি ও ড্রাগ কার্টেলের সাথে সম্পর্ক থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে।

সেইসাথে তেল চুরি করতে গিয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটার নজীরও আছে।
সেইসাথে মেক্সিকো বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।
এভাবে চলতে থাকলে মেক্সিকোর অর্থনীতি ভয়াবহ সংকটে পড়বে।
কারণ ইতিমধ্যে কেবল Los Zetas নামের কার্টেল প্রায় বিলিয়ন ডলারের আন্ডারগ্রাউন্ড তেলের বাজার তৈরি করে ফেলেছে।
তেল চুরির সাথে লস জেটাস নামের এই মাফিয়া সবচেয়ে বেশি জড়িত।


এছাড়া নাইট টেম্পলার কার্টেলের মত ভয়াবহ সংগঠনও সরাসরি জড়িত অস্ত্র এবং তেল চুরির সাথে।

প্রায় ডজনখানেক পাওয়ারফুল এবং আরো ডজনখানেক ছোট বড় কার্টেল মেক্সিকোতে রাজত্ব করতেছে। মার্কিন প্রশাসন এবং DEA বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতেছে কখনো সরাসরি আবার কখনো মেক্সিকান সরকারের সাথে মিলে কাজ করে ড্রাগ ট্রাফিকারদের সামাল দিতে।
কিন্তু কার্যত ফলাফল খুব একটা ভালো হচ্ছে না।
হাইড্রার মাথার মত একটা মাথা কাটতেছে, আরো দুইটা তৈরি হচ্ছে।

সবকথার শেষ কথা হল, ডিমান্ড থাকলে কেউ না কেউ বাইরে থেকে সাপ্লাই দিবেই।
আমাদের দেশে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ পিচ ইয়াবা প্রবেশ করে কেবল মিয়ানমান বর্ডার দিয়েই। এছাড়া হেরোইন, কোকেইন, ফেন্সিডিল, এসবের কথা তো বাদই দিলাম।
এসব কারা খায়?
অবশ্যই এই দেশের মানুষই খায়।
ডিমান্ড তাঁরা তৈরি করেছে, সুতরাং চোরেরা সাপ্লাই নিয়ে আসতেছে।

বিশাল বড় অংকের বাজার তৈরি করে ফেলেছে দেশের ভেতর। ফলে ড্রাগ ট্রাফিকারদের হাতে টাকাও যাচ্ছে মোটা অংকের। আর এই টাকা দিয়ে তাঁরা ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছে।

আমি চেষ্টা করলাম একটা ব্রিফ আইডিয়া দেবার।
অনেককিছু বাদ দিয়ে গেলাম। বাদ না দিলে লিখাটা আরো বড় হইতো। আর একটামাত্র লিখাতে ডিটেইলস সবকিছু বলা পসিবল না।
আমি কেবল ড্রাগসের আগ্রাসনের ভয়াবহ চিত্রটি তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

লিখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।









Read More »

Monday, May 29, 2017

ইন্ডিয়ান আন্ডারওয়ার্ল্ড (মাফিয়া)



১৪ জানুয়ারি, ২০০০ সাল।
ঋত্বিক রোশন অভিনীত প্রথম মুভি “কাহো না প্যায়ার হে” রিলিজ পায়। ব্লক বাস্টার হিট হয় মুভিটি। এই মুভি দিয়ে বলিউডে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌছে যায় ঋত্বিক রোশন।
২০ জানুয়ারি, ২০০০ সাল।
মুভি রিলিজের এক সপ্তাহের মাথায় মুভির পরিচালক, ঋত্বিক রোশনের বাবা, রাকেশ রোশনের উপর দুইজন অস্ত্রধারী হামলা চালায়। দুইবার গুলি করা হয় রাকেশ রোশনকে। একটি গুলি তার হাতে, আরেকটি বুকে লাগে। সেইসাথে তার গাড়ি লক্ষ করে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে পালিয়ে যায় দুই ব্যক্তি।
রাকেশ রোশন সেই যাত্রায় বেঁচে যান। সুস্থ হবার পর তিনি বলেছিলেন, অস্ত্রধারীরা তাকে খুন করতে আসেনি। যদি আসতো, তাহলে মেরে ফেলতে পারতো সহজেই। তারা এসেছিলো তাকে আহত করতে। সেইসাথে গোটা বলিউডের জন্য একটা সতর্কতা সংকেত পাঠাতে।
প্রশ্ন হল, কিসের সতর্কতা সংকেত? আর রাকেশ রোশনকে গুলি করা হল কেনো?





১৯৭০ সালে ভারত সরকার বলিউডের জন্য ব্যাংক ঋণ প্রদান নিষিদ্ধ করে।
এই ব্যান ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত ছিল।
অর্থাৎ এই সময়টাতে বলিউডকে “ইন্ড্রাস্ট্রি” হিসেবে ভারত সরকার স্বীকৃতি দিত না। ফলে ব্যাংকও লোন দেয়া হত না। একারণে পরিচালকেরা মুভির ফাইন্যান্সিংএর জন্য প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান, ধনী বিত্তশালী ও কিছু প্রতিষ্ঠিত মুভি স্টুডিওর উপর নির্ভর করতো।
আর এখানেই সুযোগ নিয়েছিল ভারতীয় মাফিয়ারা।
তাদের কাছে কালো টাকার অভাব ছিল না। সুতরাং মুভিতে তারা নগদ ইনভেস্ট করে দ্রুত রিটার্ন পেতো।
ভারতীয় মাফিয়াদের জন্য বলিউড হয়ে ওঠে লোভনীয় ব্যবসা।
যে পরিচালক মাফিয়াদের সাথে যত ভালো সম্পর্ক রাখতো, সে ততবেশি নগদ অর্থ পেতো, সুতরাং তার মুভির প্রোডাকশন ও পাবলিসিটিও তত ভালো হত।

এটা চেইন রিয়াকশন।
মাফিয়াদের কাছে প্রচুর টাকা আছে। টাকা দিয়ে তারা পলিটিসিয়ান পকেটে রাখে। সেন্সর বোর্ডের লোকদেরও পকেটে রাখে। সিনেমা হল গুলো নিয়ন্ত্রন করে। রন্ধে রন্ধে তাদের ইনফ্লুয়েন্স।
সুতরাং তাদের সাথে হাত মেলালে সবকিছু সহজ হয়ে যাবে।
ওই যে বললাম, চেইন রিয়াকশন। অর্থাৎ আপনি ওদের সাথে হাত মিলিয়ে নিজের সুবিধা আদায় করবেন। আবার আপনাকে সুবিধা দিয়ে ওরা আরো বেশি অর্থ কামাবে। তখন কামানো আরো বেশি অর্থ দিয়ে ওরা আরো বেশি ইনফ্লুয়েন্স তৈরি করতে পারবে। আরো শক্তিশালি প্রভাবশালী হবে। এই তো।

১৯৯৯ সালে এই ব্যান তুলে নেয়া হয়। অর্থাৎ এখন একজন পরিচালক এখন মুভির জন্য ব্যাংক লোন পাবেন। বলিউডকে অফিসিয়ালি ইন্ড্রাস্ট্রি হিসেবে ভারত সরকার স্বীকৃতি দেয়।
মাফিয়াদের স্বার্থে তখন আঘাত লাগে।
এতোদিন তারা বলিউডের রন্ধে রন্ধে প্রভাব বিস্তার করেছে। প্রভাবটা এতোটাই প্রকট, খোদ বলিউডকে পর্দার অন্তরাল থেকে চালায় মাফিয়ারা। মুভি দেশে বিদেশে ব্যবসা করুক আর না করুক, মাফিয়াদের মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয় মুভির পরিচালকদের।
তো রাকেশ রোশনের কাছে বাহরাইন ভিক্তিক একটি মাফিয়া দল চাঁদা চেয়েছিলো। রাকেশ রোশন চাঁদা দিতে অস্বীকার করাতে তাকে গুলি করা হয়। Ali Baba Budesh নামের কুখ্যাত বাহরাইন ভিক্তিক ইন্ডিয়ান মাফিয়া দল রাকেশ রোশনের উপর গুলি চালিয়েছিলো। এখন এই আলী বাবা বুদেশ গ্যাং নিয়ে পরে বলবো। আগে তো শুরু করি প্রথম থেকে।

সমগ্র ব্যাপারটা বুঝতে হলে ইন্ডিয়ান মাফিয়াদের কথা বলতে হবে। নেপথ্য নায়কদের কথা বলতে হবে।
সমস্যা হল, শুরু করবো কোথাথেকে?
অর্গানাইজড ক্রাইমের ইতিহাস তো হাজার বছরের পুরনো।
তবে আধুনিক ইন্ডিয়ান আন্ডারওয়ার্ল্ড বলতে আমরা যা বুঝি, সেটা বলা যাক।
আর কাহিনীর সূচনা যাকে দিয়ে, তাকে দিয়েই শুরু করা যাক। শুরু করবো তাকে দিয়ে, আর শেষ করে ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর আন্ডারওয়ার্ল্ড “ডন” দাউদ ইব্রাহিমের কাহিনী দিয়ে।

যারা ২০১০ সালের অজয় দেবগান অভিনীত Once upon a time in Mumbai মুভিটি দেখেছেন, তাদের জন্য আমার এই ধারাবাহিক লিখার প্রথম অংশের কাহিনীগুলো কমন পড়বে।
ওই মুভিতে অজয় দেবগান করেছে Mastan Haider Mirza অর্থাৎ হাজি মাস্তানের রোল, আর ইমরান হাসমী অসাধারণ অভিনয় করেছে ইতিহাসের অন্যতম কুখ্যাত ডন দাউদ ইব্রাহিমের চরিত্রে।
আধুনিক মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের জন্ম যার হাতে, তিনি হলেন হাজি মাস্তান।



হাজি মাস্তানের জন্ম তামিল নাড়ু’তে। ১৯২৬ সালে। একেবারে দরিদ্র পরিবারে জন্ম।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবার সাথে মুম্বাই এসেছিলো হাজি মাস্তান। বাই সাইকেলের দোকানে কাজ করতো। দিন মজুরি করতো। এসব করে পেটের ভাত জুটতো না।
সেই ছোট বয়সে মুম্বাই বন্দরে দিনমজুরের কাজে লেগে গেলো। সারাদিন কাজ করতো হায়দার মির্জা, ওরফে হাজি মাস্তান। হায়দার মির্জা থেকে হাজি মাস্তান হয়ে ওঠার কাহিনী সেই মুম্বাই বন্দর থেকেই।
মুম্বাইয়ের এক পাশে সাগর। আর এই সাগর হয়েই স্বর্ণ চোরাকারবারিরা ভারতে স্বর্ণ পাচার করে নিয়ে আসে।
পুলিশের চোখ ফাঁকি দেবার জন্য স্বর্ণ চোরাকারবারি’দের দরকার ছিলো হাজি মাস্তানের মত বাচ্চা ছেলেদের। ভোলাভালা চেহারার হাজি মাস্তানের সাথে পরিচয় হল কিছু স্বর্ণচোরাকারবারির। সেই ছোট বয়সে হাজি মাস্তান নিজের মুখের ভেতর স্বর্ণ লুকিয়ে মুম্বাই বন্দর পার করে দিতো পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে।
আর এভাবেই বাচ্চা বয়সে পেটের দায়ে প্রবেশ করে মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে।
বয়স বাড়তে থাকে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরে উঠতে থাকে হাজি মাস্তান।
মুলত মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসব অবৈধ স্বর্ণ ভারতে আসে। (আমাদের বাংলাদেশেও আসে। তবে বিমানবন্দর হয়ে)

একসময় কেবল স্বর্ণ নয়, আরো যত বেআইনে ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া প্রোডাক্ট মুম্বাই বন্দর দিয়ে ঢোকে, সবগুলোর সাথেই নিজেকে জড়াতে শুরু করলো হাজি মাস্তান।
মাথায় ভালো বুদ্ধি ছিল হাজি মাস্তানের। ফলে বাইরের স্মাগলারদের নজরে পড়ে গেলো সে। ওরা বুঝে গেলো, ছেলে রিসোর্সফুল।
একসময় হাজি মাস্তান হয়ে গেলো স্মাগলার। টাকা পয়সা কামানো শুরু করলো ভালোমতই। নিজের একটা বাহিনী তৈরি করলো। মুম্বাই বন্দরে অন্য যেসব স্মাগলাররা ছিল, একসময় তাদেরকেও নিজের পথ থেকে সরিয়ে দিতে শুরু করলো সে।
স্বপ্ন তার মুম্বাই বন্দরের শাহেনশাহ হবার।

(** আমাদের দেশে বিদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ প্রতিবছর বিমান বন্দর দিয়ে ঢোকে, সে খবর সবাই জানে। মাসে মাসে স্বর্ণ আটকের নিউজও আসে। কিন্তু এরপরও সেটা বন্ধ হয় না। কারণ স্বর্ণ চোরাকারবারিরা বিমান বন্দরের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে ঠিকই যোগাযোগ রাখে। এবং মাঝেমাঝে কিছু চালান চোরাকারবারীরা ইচ্ছা করেই স্যাক্রিফাইস করে। যাই হোক, সেসব আলোচনা পরে)

তো হাজি মাস্তান একসময় মুম্বাই বন্দরের স্মাগলিং নিজের নিয়ন্ত্রনে আনে।
হিসাবটা সহজ। আবার কঠিনও।
বাইরের স্মাগলারদের সাথে যোগযোগ রাখতে হবে। বাইরে থেকে অবৈধ মালামাল মুম্বাই বন্দর হয়ে হাজি মাস্তান পৌছে দেবে মুম্বাইয়ের অন্যসব মাফিয়াদের কাছে। অর্থাৎ সাপ্লাই বিজনেস।
আর এই করে মোটা টাকা। সেইসাথে কিছু অসাধু পুলিশ ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের সাথে হাজি মাস্তানের পরিচয়। তাদের ভায়া হয়ে অসাধু পলিটিসিয়ানদের সাথে পরিচয়। অর্থাৎ যেভাবে সবকিছু হয় আরকি।
কান টানলে মাথা আসার মত ব্যাপার।

হাজি মাস্তানের টাকা যত বাড়তে থাকে, ক্ষমতাও তত বাড়তে থাকে। দলবলও তত বড় হতে থাকে। প্রভাবও বাড়তে থাকে। রিচও বাড়তে থাকে। সমাজের হাইক্লাস মানুষের সাথে মেলামেশাও শুরু হয়।
সেই সাথে মুম্বাই ভিক্তিক অন্যান্য মাফিয়া লিডারদের সাথেও তার ওঠাবসা চলতে থাকে। মুম্বাইয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্যাংগুলো নিজেরা নিজেদের ভেতর মারামারি করতো। হাজি মাস্তান তাদেরকে একসাথে একটেবিলে বসায়। ঠিক যে কাজটি আমেরিকাতে Lucky Luciano করেছিলো, একই কাজ হাজি মাস্তান করে।
মুম্বাই গ্যাংগুলোকে এলাকা ভাগ করে দেয়। ব্যবসা ভাগ করে দেয়। অর্থাৎ অমুক এই অঞ্চল, তমুক ওই অঞ্চলে রাজত্ব করবে। কেউ কারো বিজনেসে ভাগ বসাবে না।
হাজি মাস্তানের এই পদক্ষেপের কারণ মুম্বাই গ্যাংগুলোর ভেতর হানাহানির অবসান হয়।
ওদিকে সাগর ও মুম্বাই পোর্টের নিয়ন্ত্রন রাখে হাজি মাস্তান।

হাজি মাস্তান মাস্তান ষাট ও সত্তরের দশকে উপলব্ধি করে, অর্থ বিনিয়োগের সবচেয়ে লোভনীয় খাত হতে পারে ভারতীয় ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি। মুম্বাই ভিক্তিক ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি, যা এখন বলিউড নামে পরিচিত, সেখানে তখন চরম অর্থঅভাব। পরিচালকেরা ছবি তৈরির জন্য ব্যাংক লোন পাচ্ছেন না। বিনিয়োগ দরকার। ক্যাশ টাকা দরকার।

হাজি মাস্তানের কাছে কালো টাকার অভাব নেই। ট্যাক্স ফ্রি বিনিয়োগ। পেছনের দরজা দিয়ে।
মুম্বাই ফ্লিম পরিচালকদের কাড়িকাড়ি টাকা ইনভেস্ট করতে শুরু করে হাজি মাস্তান।

বেশি টাকা পেলে ভালো মুভি বানাতে পারে পরিচালকেরা। আর ভালো মুভি বানালে সেটা ভালো ব্যবসা করবে। আর ভালো ব্যবসা করলে ভালো লাভ আসবে।
হাজি মাস্তান বিনিয়োগ তো উসুল করবেনই। সাথে সুধ আসল সহ।

মুম্বাই ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে বিনিয়োগ করে বেশ ভালো লাভবান হতে শুরু করে হাজি মাস্তান।
মুভির পরিচালকদের সাথে সক্ষতা গড়ে ওঠে হাজি মাস্তানের।
সেইসাথে নায়ক নায়িকাদের সাথেও।
দিলিপ কুমার, রাজ কাপুর, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জিব কাপুর, ফিরোজ খানের মত তখনকার সুপারস্টাররা ছিলেন হাজি মাস্তানের বন্ধু তালিকায়।

কথায় বলে, টাকায় টাকা আনে। সেইসাথে আনে ক্ষমতা। প্রভাব। খ্যাতি।
ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে হাজি মাস্তান রীতিমত নামকরা প্রযোজক, ফ্লিম ফাইনান্সার।
এছাড়া রিয়েল স্টেট, ইলেকট্রনিক, হোটেল বিজনেসেও ইনভেস্ট করে হাজি মাস্তান।


তখন দক্ষিণ মুম্বাইয়ের Bhendi Bazar, Dongri, Nagpada টাইপের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোর অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। চরম হতদরিদ্র মানুষগুলোর কাছে হাজি মাস্তান ছিল রীতিমত রবিন হুড।
মানুষ ঝামেলায় পড়লে পুলিশের কাছে যেতো না। ‘গডফাদার’ হাজি মাস্তানের কাছে যেত।
চাকরি বাকরির দরকার, হাজি মাস্তান তো আছে। চাকরি দিয়ে দেবে। হাজি মাস্তানের ব্যবসা বানিজ্যের অভাব নেই। একটা না একটা জায়গায় তো ব্যবস্থা ঠিকই করে দেবে।
দক্ষিণ মুম্বাইয়ের মুসলিম অধ্যুষিত এসব অবহেলিত জায়গায় হাজি মাস্তান অনেক বড় সেলিব্রিটি।

অর্থাৎ সেই গডফাদার মুভিতে যেটা দেখায়।
দেশে দেশে ঘটনাগুলো ঠিক একই রকম। কিছুটা ভিন্ন মোড়কে।
সেইসাথে আরো একটা জিনিস ভাবার বিষয় আছে। নিউইয়র্ক আন্ডারওয়ার্ল্ডের লাকি লুচিয়ানো, ভিটো জেনোভিচ, বাকসি সিগ্যাল, এরা সবাই উঠে এসেছিলো ইহুদি বস্তিগুলো থেকে। অবহেলিত, চরম দরিদ্র বস্তি থেকে।
মুম্বাইয়ের দাউদ ইব্রাহিমের উত্থানও হবে মুম্বাইয়ের সংখ্যালঘু হতদরিদ্র এলাকা থেকে। সেই গল্প একটু পরে।

তো হাজি মাস্তান ছিল মুম্বাইয়ের প্রথম সেলিব্রিটি গ্যাংস্টার। যাকে মাফিয়া ডন, বা গডফাদার আপনি বলতেই পারেন।
হাজি মাস্তান অন্যান্য মুম্বাই ও তামিলনাড়ু ভিক্তিক গ্যাংস্টারদের সাথে লিয়াজো করেই চলতো। ব্যবসা বানিজ্য ভাগভাটোয়ারা করে নিয়েছিলো। যাতে আন্ধকার জগতের এসব খলনায়কদের ভেতর বড়ধরণের যুদ্ধ শুরু না হয়।

হাজি মাস্তানের ব্যবসা ছিল অবৈধ স্বর্ণ চোরাচালান, ট্যাক্স বহির্ভুত মদ, ইলেকট্রনিক্স, বেআইনিভাবে আনা অস্ত্র, এসব ছিলো হাজি মাস্তানের মুল ব্যবসা। সেইসাথে একসময় রিয়েলস্টেট, ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রি, হোটেল বিজনেসে ইনভল্ভ হয়েছিলেন হাজি মাস্তান। কিন্তু তার নামে Narcotics অর্থাৎ মাদক দ্রব্যের অর্থাৎ হেরোইন, কোকেনের মত দ্রব্যের ডিলিংসের কোনো অভিযোগ ছিল না। সেগুলো অন্যরা করতো।

তো ১৯৯৪ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান হাজি মাস্তান।
অজয় দেবগানের Once upon a time in Mumbai মুভির শেষটা যেভাবে দেখানো হয়েছে, সেভাবে নয়।

হাজি মাস্তান নিজেকে পরিচয় দিতেন “সোলেমান মির্জা” হিসেবে।
হাজি মাস্তান নামটি মিডিয়ার দেয়া।

হাজি মাস্তান পেটের দায়ে খারাপ হয়েছিলো।
আর এবার যার কথা বলবো, সে খারাপ হয়েছিলো স্বভাবগতভাবেই।
আন্ডারওয়ার্ল্ডে যে নাম সবচেয়ে পরিচিত, আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম।



বাপ তার পুলিশ। মুম্বাই পুলিশের কন্সটেবলের চাকরি করতেন। মা গৃহিনী।
বেড়ে ওঠা দক্ষিন মুম্বাইয়ের Dongri এলাকাতে।
ছোটবেলা থেকে গোঁয়ার, ডানপিটে ছিল দাউদ ইব্রাহিম।
পরিবার থেকে যতটুকু সম্ভব সাপোর্ট দেয়া হলেও উচ্চভিলাসী দাউদ বখে যাওয়া বন্ধুবান্ধবের সাথে ছোটবেলা থেকেই চুরি, ছিনতাই শুরু করে।
দাউদের বাবার কাছে অভিযোগ আসতো। দাউদ মার খেতো। কিন্তু এতে দাউদ আরো বখে যেতে শুরু করে।
লিখাপড়া বাদ দিলো দাউদ।
সারাদিন এলাকায় টো টো করে ঘুরতো। এলাকার মাস্তানে পরিনত হয় সেই বয়সে।
এরপর দাউদের বাবা পুলিশের লোক হয়েও ধর্না দিলেন হাজি মাস্তানের কাছে।
সেটা ষাটের দশকের শেষদিকের কথা।
হাজি মাস্তান দাউদের জন্য ছোটখাটো একটা কাজ জোগাড় করে দিলেন। কিন্তু সেটা দাউদের পোষালো না।
সে ধনী হতে চায়।
হাজি মাস্তানের কারবার সম্পর্কে দাউদের বেশ ভালো ধারণাই ছিল।
দাউদ ছুটে গেল হাজি মাস্তানের কাছে।
বললো, আমি আপনার কাছের লোক হতে চায়। আপনার ব্যবসায় যোগ দিতে চাই।

দাউদের ভেতর হাজি মাস্তান কিছু একটা দেখেছিলো। এই ধরণের ছেলেকে দিয়েই কাজ হবে। ওর ভেতর কিছু একটা আছে !!
দাউদ ঢুকে গেলো হাজি মাস্তানের স্মাগলিং বিজনেসে।
হাজি মাস্তানের খাস লোক হতে শুরু করে সে।

হাজি মাস্তানের সাথে থেকে থেকে স্বর্ণলতার মতই বেড়ে ওঠে দাউদ।
হাজি মাস্তান যে কাজটা কখনোই করেনি, দাউদ এবার সেই কাজটি করা শুরু করে। হাজি মাস্তানের স্মাগলিং বিজনেসে ঢুকে narcotic অর্থাৎ মাদক দ্রব্য মুম্বাই বন্দর দিয়ে স্মাগলিং শুরু করে দাউদ।
আর এই নিয়ে হাজি মাস্তানের সাথে দাউদের বিবাদ তৈরি হয়।
দাউদ হাজি মাস্তানের মত কেবল মুম্বাইএর বন্দরের রাজা হতে চায়নি। সে চেয়েছিলো গোটা মূম্বাই শহরে রাজত্ব করতে। গোটা মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড নিজের দখলে নিতে।
দাউদের মাদকপাচারে হাজি মাস্তান বাধা দেয়। দাউদের দুইজন খাস লোক’কে হাজি মাস্তানের লোকেরা আক্রমন করলে অফিসিয়ালি হাজি মাস্তানের দল থেকে বেরিয়ে যায় দাউদ ইব্রাইম।

তৈরি করে তার "The Young Company" যেটা পরবর্তীকালে “D-Company” নামে গোটা দুনিয়াতে পরিচিত হয়।

মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড আশির দশকের শুরুর দিকে এসে বদলে যেতে শুরু করে। দাউদের প্রভাবে।
হাজি মাস্তান মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে যে নিয়ন্ত্রন এনেছিলো, দাউদ ঝড়ে সেটা বেসামাল হয়ে যায়। দাউদের কোনো ক্ষুদ্র অঞ্চল নয়, গোটা ব্যবসা চায়। গোটা মুম্বাই সে চায়।

মুম্বাইয়ের অন্যান্য গ্যাংদের সাথে গুটিবাজি শুরু করে প্রথমে সে হাজি মাস্তানের প্রভাব কমাতে শুরু করে। ঘটনা চক্রে সেসময় অর্থাৎ আশির দশকের দিকে হাজি মাস্তানও অবৈধ স্মাগলিং ব্যবসা বাদ দিয়ে ফ্লিম ইন্ড্রাস্ট্রি আর রিয়েল স্টেট নিয়েই পড়ে থাকে। আর এই ভ্যাকুয়াম দাউদ পুরন করতে শুরু করে।
গোটা আশির দশকে দাউদ মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।

এবং আশির দশকের শেষ দিকে, মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে একচেটিয়া দাউদ ইব্রাহিমের রাজত্ব।
হাজি মাস্তানের গ্রুপ ততদিনে দাউদের নিয়ন্ত্রনে।

হাজি মাস্তান মুম্বাই ও ভারতের অন্যান্য জায়গার ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলোর সাথে পার্টনারসিপ ভিক্তিতে ব্যবসা চালাতো। কিন্তু দাউদ এসে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রনে নেয় সবকিছু। হয় তার কথামত চলতে হবে, অন্যথায় মরতে হবে।

দাউদের হাত কেবল ভারতে সীমাবন্ধ থাকেনি। দাউদ তার অন্ধকার সম্রাজ্য বিস্তার করে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে। আর্মেনিয়ান মাফিয়া, রুশ মাফিয়া, এশিয়ান মাফিয়াদের সাথে মিলে বিশাল এক ক্রাইম নেটওয়ার্কে যুক্ত হয়ে যায় দাউদ।
মানি লন্ডারিং ব্যবসা, নারী পাচার, আফগানি হেরোইন এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে দেয়া, আফগানিস্তানে সোভিয়েত বিরোধি যুদ্ধে অস্ত্র পাচার করেও দাউদ প্রচুর অর্থ কামানো শুরু করে।
নব্বয়ের দশকের শেষদিকে দাউদ ইব্রাহিম তালিবান প্রটেকশন নিয়ে আফগানিস্তানে গিয়ে ওসামা বিন লাদেনের সাথে দেখা করে। মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া এবং আফ্রিকাতে অস্ত্র ব্যবসা, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বড়বড় দেশে বিপুল পরিমাণ আফগানি হেরোইন সাপ্লাই দিতে থাকে দাউদ।
মুম্বাইয়ের রিয়েলস্টেট ব্যবসাতেও দাউদ ভাগ পেতে শুরু করে।
ধরুন, কোনো রিয়েলস্টেট ব্যবসায়ী মেগা প্রজেক্ট করবে এমন একটা জায়গায় যেখানে বিশাল বস্তি। তো এই বস্তি উচ্ছেদ করতে হবে।
এই ধরণের কাজে দাউদের ক্রাইম সিন্ডিকেট বেশ ইফেক্টিভ। রাতের আধারেই এরা গোপনে কাজ করবে। ভয় ভীতি দেখিয়ে, আতংক তৈরি করে বস্তি উচ্ছেদ করবে দাউদের দল। এবার সেখানে যখন রিয়েল স্টেট ব্যবসা রমরমা হবে, তখন দাউদ ভাগ পাবে।
মুম্বাইয়ের বিখ্যাত ফ্লিম ইন্ডাস্ট্রিতে তখন দাউদের দাপট।





মধ্যপ্রাচ্যে শারজাহ কাপ চলে, আর দাউদের জুয়া খেলার বিজনেসও রমরমা হয়।
ম্যাচ ফিক্সিং কেন হয়?
এসব বেটিং যারা করে, জুয়া যারা খেলে, তারাই এই ম্যাচ ফিক্সিং করে।




ভারতের সাবেক ক্রিকেটার দিলিপ ভেন্সারকার ২০১৩ সালে এক ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, ১৯৮৬ সালে দাউদ ইব্রাহিম শারজাহ কাপ চলার সময় ইন্ডিয়ান ক্রিকেট দলের ড্রেসিংরুমে ঢোকে, এবং প্রতিটি ইন্ডিয়ান ক্রিকেটারকে একটা করে ব্রান্ড নিউ গাড়ি অফার করে যদি তারা ফাইনাল ম্যাচ পাকিস্তানকে হারাতে পারে।

ব্যাপারটা হল, দাউদ ইব্রাহিম ফাইনাল ম্যাচে ইন্ডিয়ার হয়ে বেট ধরবে। এজন্য ইন্ডিয়ার জেতাটা তার জন্য জরুরী।
সিম্পল হিসাব।

দাউদ ইব্রাহিমের আন্ডারওয়ার্ল্ড আশির দশকের শেষদিকে রীতিমত রমরমা। ওই যে বললাম, আশির দশকে আফগানিস্তানের যুদ্ধে দাউদ ইব্রাহিম অস্ত্র ব্যবসা করেছিলো, আর সেই সুবাদেই দাউদের সাথে পাকিস্তানি গোয়েন্দাসংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স, অর্থাৎ ISI এর সখ্যতা তৈরি হয়। আর আইএসআই এর সাথে দাউদের এই সম্পর্ক মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডকে একেবারেই বদলে দেবে।
সেই কাহিনী এবার বলছি।

১৯৯২ সাল। অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা নিয়ে ভারতে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেই দাঙ্গায় দুই হাজারের উপর মানুষ মারা যায়। তবে বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি হবে, কম নয়।
মুম্বাইয়ের অবহেলিত মুসলিম অধ্যুষিত দক্ষিণ অংশের এলাকাগুলোতেও দাঙ্গায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এবার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ড রীতিমত বদলে যায়।

দাউদ ইব্রাহিম যত অকাম কুকামই করুক, ভারতে মুসলিম পরিবারে জন্ম নেবার সুবাদে তার ভেতরও সেই সময় আইন্ডেন্টিটি ক্রাইসিস কাজ করেছিল। এছাড়া হাজি মাস্তানের দেখাদেখি দাউদ দক্ষিণ মুম্বাইয়ের মুসলিম অধ্যুষিত গরিব এলাকাগুলোতে “রবিন হুড” গীরি করতো।
মানুষ সমস্যায় পড়লে পুলিশের কাছে না গিয়ে দাউদের লোকেদের কাছে যায়। দাউদ এলাকার মুসলিম বেকার ছেলেপেলেদের জন্য কাজেরও ব্যবস্থা করে দেয়।
দক্ষিন মুম্বাইয়ের এসব মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাতে দাউদের বেশ জনপ্রিয়তা ছিল।
খেয়াল করে দেখুন, বিখ্যাত কলম্বিয়ান ক্রাইম বস পাবলো এসকোবার কিন্তু তার এলাকা মেডিলিনের মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল। এখানে ভোটে দাঁড়িয়ে পার্লামেন্টের মেম্বারও হয়েছিল। ‘রবিন হুড’ রোল সেও প্লে করতো।
দুইটা কারণে।
নিজের এলাকার মানুষের কাছে একটা ভালো ইমেজ ধরে রাখতে। অর্থাৎ আমি চুরি করি আর যাই করি, তোমার জন্য করি। তোমাদের বিপদে আমি আছি, সুতরাং কোনোদিন আমার বিপদ হলে তোমরা আমার সাথে থাকবা।
আবার আরেকটা কারণ হল,
এই ধরণের হতদরিদ্র মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের উপকার করলে চরম লয়েল সাপোর্ট পাওয়া যায়। লয়েল সাপোর্টার তৈরি করা যায়।

তো যাই হোক, দাউদ সিদ্ধান্ত নেয়, সে মুম্বাই উড়িয়ে দেবে। ভারত সরকারকে উচিৎ শিক্ষা দেবে।
এরপর সে যা করে, সেটা রীতিমত ভয়ংকর।

১৯৯৩ সালের মার্চ মাসের ১২ তারিখ।
• Mumbai Stock Exchange Building
• Passport Office
• Masjid- Mandvi Corporation Bank Branch
• Fisherman's Colony in Mahim causeway
• Zaveri Bazaar
• Plaza CinemaCentury Bazaar
• Katha BazaarHotel Sea Rock
• Terminal at Sahar Airport (now known as CSIA)
• Air India Building
• Hotel Juhu Centaur
• Worli
ভারতের মুম্বাই শহরের এই গুরুত্বপূর্ন স্থানগুলো সিরিজ বোমা হামলায় কেপে ওঠে। ২৫৭ জন মানুষ মারা যায়। ৭১৭ জন হতাহত হয়।
বোমা হামলা মুম্বাই শহর থমকে যায়।











এই হামলার ফলে আরেকটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয় গোটা ভারত জুড়ে। যার ফলে আরো মানুষের প্রাণ যায়।

দাউদ ইব্রাহিম দুবাইতে তার বিলাসবহুল বাড়িতে বসে এই হামলার অর্ডার দিয়েছিলো। আর সমগ্র হামলার প্লান তৈরি করেছিল দাউদের ডান হাত হিসেবে পরিচিত “টাইগার মেনন”
টাইগার মেনন এখনো ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে আছে।



গাড়ি বোমা থেকে শুরু করে মোটর সাইকেল বোমা, ব্রিফকেস বোমা, এসব ব্যবহার করা হয়েছিলো এই হামলায়।
এটা ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা।

দাউদ ইব্রাহিমের যেসব ফুট সোলজার এই হামলাতে অংশগ্রহন করেছিল, এদের অধিকাংশ ছিল বেকার যুবক। বাবরি মসজিদ ধ্বংস পরবর্তী দাঙ্গার সেন্টিমেন্ট ব্যবহার করে এসব ছেলেদের রিক্রুট করা হয়েছিলো।
এই হামলা পরিচালনায় অংশগ্রহনকারী ফুট সোলজারদের দাউদ পাকিস্তানে বা দুবাইতে নিয়ে যেতে পারেনি। ভারতীয় পুলিশ তাদের কয়েকজনকে আটক করে। বাকিরা এনকাউন্টারে মরে, কেউ আবার আটকের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যা করে।
২০০৭ সালের মুভি Black Friday তে মুম্বাই হামলার পর পুলিশ যেভাবে হামলাকারি ফুট সোলজারদের ধরেছিল, সেটার উপর ভিক্তি করে বানানো। মুভিটি দেখতে পারেন।

দাউদ ভেবেছিলো এই হামলার পর ভারতের মুসলিমদের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। কিন্তু হয়েছে উল্টাটা। দাউদ ইব্রাহিম যে কত বড় সন্ত্রাসী, সেটাই বরং সবার সামনে আরো পরিস্কার হয়ে যায় এই হামলার পর।
ঠিক পাবলো এসকোবারও কলম্বিয়াতে এই একই ভুল করেছিল। বিশাল গাড়ি বোমা হামলা চালিয়ে কলম্বিয়ার রাজধানী কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। প্রচুর নিরীহ মানুষ খুন করেছিল।


এখানে বলে রাখি, ভারতের নামকরা অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত এরেস্ট হয়েছিল এই মুম্বাই হামলার পর। Terrorist and Disruptive Activities (Prevention Act) এর অধিনে সঞ্জয় দত্ত এরেস্ট হয় অবৈধ অস্ত্র রাখার অভিযোগে। পুলিশ অভিযোগ এনেছিল, সঞ্জয় দত্ত মুম্বাই হামলার কথা আগে থেকেই জানতো। পুলিশের অভিযোগ, মুম্বাই হামলার পর সৃষ্টি হওয়া দাঙ্গায় অস্ত্র সরবরাহ করার কাজটি সঞ্জয় দত্তকে দিয়ে করাতে চেয়েছিল দাউদ।
যাই হোক, সঞ্জয় দত্তের পাঁচ বছরের জেল হয় পরে। সঞ্জয় দত্তের বাবা তখন ভারতের এমপি।
http://www.dnaindia.com/india/report-here-s-why-sanjay-dutt-is-in-jail-2046779

মুম্বাই হামলার পর মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে পরিবর্তন আসে। দাউদের ডি কোম্পানি’তে যেসব হিন্দু গ্যাং মেম্বার ছিল, তারা আলাদা হয়ে যায়। দাউদের আন্ডারওয়ার্ল্ডে ভাঙ্গন ধরে।
দাউদের একসময়কার ডান হাত ‘ছোট রাজন’ দাউদের শত্রু হয়ে যায়।



এরপর মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডে শুরু হয় মারামারি। দাউদের লোকেরা ছোট রাজনের লোকদের মারে। ছোট রাজনের লোকেরা দাউদের লোকদের মারে।
এই মারামারি আজও চলতেছে।

২০০০ সালে থাইল্যান্ডের ব্যাংককে নাটকীয় কায়দায় দাউদ ইব্রাহিমের লোকেরা ছোট রাজনকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায়। কিন্তু সে যাত্রায় ছোট রাজন অল্পের জন্য বেঁচে যান।

২০১৫ সালে ছোট রাজন গ্রেফতার হল ইন্দোনেশিয়ার বালি উপদ্বীপে। এখন ভারতের আদালতে তার বিচার চলতেছে।



ওদিকে দাউদ ইব্রাহিম কখনো দুবাই, কখনো পাকিস্তানে অবস্থান করে।
মার্কিন প্রশাসন তাকে মোস্ট ওয়ান্টেড সন্ত্রাসীর লিস্টে রেখেছে।
বর্তমান দুনিয়ার শীর্ষ ১০ মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তির তালিকাতে দাউদ ইব্রাহিম আছে তিন নাম্বারে।

শত কোটি টাকা তার মাথার মুল্য।
অথচ সে দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিম এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০০৬ সালে দাউদ ইব্রাহিমের মেয়ে Mahrukh Ibrahim, এর সাথে বিয়ে হয় পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদের ছেলের।
এই বিয়ের অনুষ্ঠান হয়েছিল দুবাইয়ে। ধুমধাম করে এই বিয়ে হয়েছিল। এবং বিয়ের সময় ইন্টারপোল রেড এলার্ট জারি করে রেখেছিল। কিন্তু দাউদ সামহাউ সেই বিয়েতে এসেছিল।
টাকা থাকলে আর আইএসআই’এর মত এতো কুখ্যাত একটা গোয়েন্দা বাহিনী পকেটে থাকলে এসব হয়ত করাই যায়। ফিল্মি স্টাইলে।

দাউদ ইব্রাহিমের আরেক মেয়ে মেহরিনের বিয়ে হয় পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত এক মার্কিন নাগরিকের সাথে।
তার ছেলের বিয়ে হয়েছে লন্ডনের এক ধনুকুব ব্যবসায়ীর মেয়ের সাথে।


হাজি মাস্তান মুম্বাইয়ের বন্দর থেকে শুরু করেছিল তার কারবার। মুম্বাই বন্দর হয়েই ১৯৯৩ সালের বোমা হামলার জন্য প্রচুর পরিমাণ বোমা ও অস্ত্রসস্ত্র ভারতে ঢুকেছিল।
আবার এই ২০০৮ সালে মুম্বাই হামলায় অংশগ্রহনকারী সন্ত্রাসীরাও মুম্বাইয়ে ঢুকেছিল সাগর দিয়ে।


লিখার শুরুতেই বলেছিলাম, রাকেশ রোশনের উপর গুলি চালিয়েছিলো আলী বুদেশ।
এই আলী বুদেশ প্রথম জীবনে ছিল একজন পকেটমার।




মুম্বাইয়ের বস্তি এলাকায় পকেটমারী ও ছিচকে চুরি করতো।
এরপর যা হবার, অর্থাৎ একসময় দাউদ ইব্রাহিমের লোকেদের নজরে এলো। এরপর দাউদ ইব্রাহিমের ডি কোম্পানিতে যোগ দিয়ে বড় গুন্ডা হয়ে গেলো।
একসময় দাউদ ইব্রাহিমের সাক্ষাৎপেতে সে দুবাই গেল। মুম্বাই মাফিয়াদের জন্য ইহা নাকি এক বিরাট সম্মান। অর্থাৎ দাউদ ইব্রাহিমের দেখা পাওয়া।

যাই হোক, একসময় বুদেশ দাউদ ইব্রাহিমের কিছু লোকজন নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। বাহরাইনে ঘাটি গেড়ে সেখান থেকে অকাম কুকাম চালিয়ে যাচ্ছে সে।

দাউদ ইব্রাহিম তাকে হত্যার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে বহুদিন ধরে। দাউদ ইব্রাহিমের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছোট সাকিলের উপর দায়িত্ব পড়েছে আলী বুদেশকে শেষ করার।
কিন্তু এখন পর্যন্ত সে বুদেশ বেঁচে আছে।

আলী বুদেশও অন্যান্য মাফিয়াদের মত বলিউডের প্রতি ইন্টারেস্টেড। আফটার অল, ইনভেস্ট করার জন্য বলিউড সবসময় লোভনীয় জায়গায়। কাঁচা টাকা ইনভেস্ট করে নগদে প্রচুর কাঁচা টাকা কামানো যায়।

বলিউডে মাফিয়াদের এই প্রভাব, আজ পর্যন্ত আছে।
ওদিকে আফগানিস্তানে হেরোইনের রমরমা উৎপাদন হচ্ছে।
Golden Crescent আর golden Triangle এই দুইটা জায়গার নিয়ন্ত্রণে রাখা এশিয়ান মাফিয়া দলগুলোর জন্য মুল ব্যাটলফিল্ড।




( পরের পর্বে থাকবে অন্যকোনো দেশের অন্যকোনো মাফিয়া চক্র নিয়ে লিখা।
আমি বেশি ডিটেইলসে যাবো না। জাস্ট একটা ধারণা দিয়ে যাবো )

( চলবে......... )















Read More »