ভদ্রলোকের নাম সমরেন্দ্রনাথ সেন।
ডাক নাম টিনু।
জন্ম ১৯১৪ সালে, ঢাকা শহরে।
স্কুল কলেজ পাস করে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর চলে যান বিলেতে। উচ্চশিক্ষার জন্য।
১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ভারতের সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন।
কাজ করেছেন লন্ডনের ভারতীয় হাইকমিশনে, রাষ্ট্রদুত হিসেবে কাজ করেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, আলজেরিয়াতে।
১৯৬৯ সালে তিনি জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পান।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জাতিসংঘ অধিবেশনগুলোতে বারবার উঠে আছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ। সমর সেন রেখেছেন জোড়ালো ভূমিকা। তথ্য উপাত্ত দিয়ে বাংলাদেশে চলমান গনহত্যার বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজরে আনতে লাগলেন সমর সেন।
১৯৭১ সালের ৫ই অক্টোবর সমর সেন জাতিসংঘের সাধারন অধিবেশনে একটি বক্তব্য রাখেন। যার একটি অংশ নিচে তুলে দিলামঃ
" শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালিদের জেগে ওঠা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ভারতকে দায়ী করেছেন পাকিস্তানের প্রতিনিধি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানিরাই তাদের অস্তিত্বের জন্য, তাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এই প্রতিরোধ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারত সরকারের হস্তক্ষেপ করা বা না করার ওপর তাদের এই লড়াই নির্ভরশীল নয়। এঅবস্থার পরিবর্তন হবে তখনই, যখন শোষক ও শোষিতের মধ্যে রাজনৈতিক আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, পাকিস্তানের প্রতিনিধি মাহমুদ আলী এই ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি"
মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্টারন্যাশন্যাল ডিপ্লোমেসিতে বাংলাদেশের পক্ষে অসমান্য অবদান রেখেছিলেন সমর সেন। টানা পাঁচ বছর জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন সমর সেন।
বাংলাদেশ স্বাধীনের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ সে সময়ে ভারতীয় ফরেন মিশনগুলোর মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ছিল প্রায়োরিটির দিক থেকে উপরে। বাংলাদেশে প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হয়ে এসেছিলেন সূবিমল দত্ত। উনার আদি বাড়ি ছিল চট্রগ্রামে।
১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তো প্রথা হল, অন্য কোনো দেশের শীর্ষ পর্যায়ের মেহমান কোনো দেশ সফরে এলে ঐ দেশে অবস্থান করা রাষ্ট্রদূতেরা বিমানবন্দরে গিয়ে তাকে স্বাগত জানান। ভুট্টোকে স্বাগত জানানোর পক্ষপাতি ছিলেন না সুবিমল দত্ত। ভদ্রলোক পদত্যাগ করলেন। চলে গেলেন বাংলাদেশ ছেড়ে। ভুট্টোকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে উপস্থিত ছিলেন উপ-হাইকমিশনার জে এন দীক্ষিত।
তো ইন্দ্রীরা গান্ধী সমর সেনকে সুবিমল দত্তের জায়গায় নিযুক্ত করলেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার।
একবছর পর পচাত্তরের ১৫ই আগস্ট ঘটে গেল ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মোশতাক সরকার ক্ষমতায়। ভারত বিরোধি হাওয়া তখন তুঙ্গে। পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন তৈরি হতে পারে, এমন কথাবার্তা আকাশে বাতাসে প্রচার হতে লাগলো। চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল।
সেই কঠিন সময়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন সমর সেন।
তিনি খন্দকার মোশতাককে বলেছিলেন, যদি গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করা হয় এবং কোনো দেশের সঙ্গে কনফেডারেশন করা হয়, তাহলে ভারতের কাছে থাকা বৈধ চুক্তির আওতায় ভারতের সেনাবাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।
যাই হোক।
তো আজকে সমর সেন'কে নিয়ে লিখলাম। সাথে একটা ঘটনাও বলি।
এই সমর সেন বাংলাদেশে নিযুক্ত হাইকমিশনার থাকা অবস্থায় ঘটে যায় আরো একটি ভয়াবহ ঘটনা।
১৯৭৫ সালের ২৬শে নভেম্বর।
কার্যত জিয়াউর রহমান তখন ক্ষমতায়। কর্নেল তাহের তখন বন্দি।
তো জাসদের তৈরি বিপ্লবি গনবাহিনীর পরিকল্পনা করেছিলো মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জিম্মি করে মুক্তিপণ হিসেবে কর্ণেল তাহেরকে মুক্ত করতে। কিন্তু পরে সেই পরিকল্পনা বদলে তারা অভিযান চালিয়েছিলো ভারতীয় হাইকমিশনে। এই পরিকল্পনা ছিল কর্নেল তাহের ভাই অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের।
১৯৭৫ সালের ২৬শে নভেম্বর, জাসদের বিপ্লবী গনবাহিনীর ৬ জনের একটি দল হামলা চালায় ভারতীয় হাইকমিশনে।
সমর সেনকে তারা ধরেও ফেলেছিলো।
কিন্তু হাইকমিশনের ভেতরেই যে ভারতীয় কমান্ডো বাহিনীর সদস্যরা ছিল, সেটা তখন অনুমানও করতে পারেনি হামলাকারিরা। বেলাল, বাহার, সবুজ, হারুন, বাচ্চু, মাসুদ। ছয় জনের ভেতর চারজন হাইকমিশনের ভেতরেই গুলিখেয়ে স্পটডেড। বাকিদুইজন আহত।
হাইকমিশনার সমর সেনও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।
এই ঘটনার পর রীতিমত হুলুস্থল লেগে গেল। জিয়াউর রহমান শুরু করলেন জাসদের বিরুদ্ধে ক্রাকডাউন।
তো ভারতীয় হাইকমিশনে জাসদের হামলার এই ঘটনা নিয়ে মহিউদ্দিন আহমদের একটা বই আছে। বেঁচে যাওয়া হামলাকারী সহ মৃত হামলাকারিদের আত্মীয়স্বজনের ইন্টারভিউ আছে বইটিতে। কারো আগ্রহ থাকলে পড়ে দেখতে পারেন।
সমর সেনের কাধে গুলি লেগেছিল।
তিনি চিকিৎসার জন্য ভারত যাননি। বাংলাদেশেই চিকিৎসা নিয়েছিলেন।
১৯৭৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেন সমর সেন। এরপর সুইডেনের রাষ্ট্রদুত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ছিলেন ভারতের দিল্লি পলিসি গ্রুপে। পরবর্তীতে আবারও কাজ করেছেন জাতিসংঘে। জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনান তার ভুয়সী প্রশংসা করেছিলেন।
২০০৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে মারা যান ঢাকাতে জন্ম নেয়া সমর সেন।