ইনি একমাত্র ব্যক্তি, যাকে ইসরাইলিরা Hero মানে,
আবার মিশরীয়রাও Hero বলে দাবি করে।
প্রশ্ন হল, আসলে তিনি কার? :P
ভদ্রলোক সম্ভবত ইতিহাসের সবচেয়ে হাই প্রোফাইল ডাবল এজেন্ট।
আর যদি তা নাও হন, অন্তত সবচেয়ে হাই-প্রোফাইল "স্পাই"
তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
যতটা সম্ভব সংক্ষেপে তার কাহিনী বলার চেষ্টা করবো।
মিশরীয় এই ভদ্রলোক কায়রো ইউনিভার্সিটিতে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া অবস্থায় মিশরীর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট, আরব বিশ্বের আইরন ম্যান, প্যান আরব মুভমেন্টের রুপকার গামাল আব্দেল নাসেরের মেঝ মেয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন।
অতঃপর বিয়ে।
টিপিক্যাল মেয়ের বাপের মতই নাসেরও মেয়ের প্রেমিক'কে প্রথমদিকে সহ্য করতে পারেননি।
তিনি শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখতেন।
ভাবতেন, ছেলে গোল্ড ডিগার।
ক্ষমতার লোভে, নাসের পরিবারের কাছাকাছি আসতেই মেয়েকে প্রেমের জালে ফাসিয়েছে।
বিয়েতে আপত্তি করেছিলেন নাসের। কিন্তু মেয়ে শুরু করলো বায়না। অতঃপর মেনে নিলেন নাসের। হয়ে গেল মেয়ের বিয়ে।
বিয়ের পর মেয়ের জামাইয়ের জন্য বিলেতের ইউনিভার্সিটিতে পড়ালিখার ব্যবস্থা করে দিলেন নাসের।
মেয়ে আর মেয়ের জামাই থাকতে শুরু করলো বিলেতে।
লন্ডনে।
আশরাফ মারওয়ানের ফ্যাসিনেশন ছিল ওয়েস্টার্ন লাইফের প্রতি।
ডিস্কো'তে গিয়ে নাচানাচি, বারে গিয়ে মদ গেলা,
এসব করতেন সময় পেলে।
তবে নিজের স্ত্রীর সাথে চিটিং করেছে, এমনটি জানা যায়নি।
আফটার অল, নাসেরের মিশরীয় গোয়েন্দা বাহিনীর একটি দল ঠিকই নজরে রেখেছিলো মারওয়ানকে।
ওই যে বললাম, নাসের খুব একটা পছন্দ করতেন না নিজের মেয়ের জামাইকে।
ভাবতেন গোল্ড ডিগার।
অযোগ্য।
সুযোগ সন্ধানী।
নাসের নিজের মেয়েকে চাপও দিতে থাকে, ডিভোর্স নেবার জন্য। কিন্তু কোনোমত সংসার টিকে থাকে।
কিন্তু ভদ্রলোক আশরাফ মারওয়ান কিছুটা অপমান, হিউমিলিয়েশন, শ্বশুরের কটাক্ষ,
এসব সহ্য করতে না পেরে, এবং মূলত টাকার লোভে একদিন মাথা গরম করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে টাকার বিনিময়ে দেশ বিক্রি করবেন।
হঠাৎ একদিন মাথা গরম করে ফোন দিয়ে বসলেন লন্ডনে অবস্থিত ইসরাইলি এম্ব্যাসি'তে।
দুতাবাসের লোকেরা ফোন রিসিভ করেছিলো। মারওয়ান নিজের পরিচয় দিলেন। এবং এড্রালিনরাসে বেকুবের মত বলে ফেললেন, "আমি আশরাফ মারওয়ান। গামাল আব্দেল নাসেরের মেয়ের জামাই। ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে শেয়ার করার মত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমার কাছে আছে। আমি এম্ব্যাসিডরের সাথে কথা বলতে আগ্রহী"
এম্ব্যাসিডরের সাথে কথা বলা হল না তার। অন্যপাশ থেকে যিনি ফোন রিসিভ করেছিলেন, তিনি কিছুই না বলে ফোনটি কেটে দিলেন।
মারওয়ান বাড়ি ফিরে গেল। পাগলামী আর শ্বশুরের উপর রাগ করে কি বড়সড় ভুলই না করতে বসেছিলেন তিনি !!
ভাগ্যিস, ঘটনা বেশিদুর আগাইনি। এম্ব্যাসিডর যদি ফোন ধরতো, তাহলে ঝামেলা হয়ে যেত। খোদা যা করে, ভালো জন্যেই করে। অল্পের জন্য বেচে গেছি।
কিন্তু আশরাফ মারওয়ান ফেসে গেছেন। তার এই ছোট্ট কনভারসেশন ইতিমধ্যেই রেকর্ড হয়ে গেছে ইসরাইলি দুতাবাসে।
আর এই রেকর্ডই কিছুদিন পর ইসরাইলিরা তাকে শুনিয়ে করবে ব্ল্যাকমেইল।
এবং সেটাই হল।
ইসরাইলি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের লোকেরা যোগাযোগ করলো মারওয়ানের সাথে।
হিসাব সহজ। তথ্য দাও, মোটা অংকের টাকা না।
আর তথ্য না দিলে, সেই কল রেকর্ডিং পাঠিয়ে দেয়া হবে মিশরের পত্রপত্রিকাগুলোতে।
আশরাফ মারওয়ান এবার ইসরাইলিদের হয়ে কাজ শুরু করলেন।
নাটকীয়ভাবে, কিছুদিনের ভেতরই হার্টএট্যাকে গামাল আব্দেল নাসের মারা গেলেন। মারওয়ান ও তার স্ত্রী ফিরে গেলেন মিশরে। নাসের মৃত্যুর পর নাসেরের ডেপুটি আনোয়ার সাদাত দায়িত্ব নিলেন মিশরের।
মিশরের আইরন ম্যান হিসেবে ক্ষমতায় এসেছিলেন নাসের। ছিলেন বিপুল জনপ্রিয়।
সুয়েজ খাল জাতীয়করন করেছিলেন নাসের। আরব বিশ্বের সবচেয়ে পপুলার নেতা ছিলেন। প্যান আরব মুভমেন্ট ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে। সেই নাসের মারা গিয়েছিলেন অনেক আক্ষেপ নিয়ে। কারণ মৃত্যুর তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া ১৯৬৭ এর যুদ্ধ।
মাত্র ছয় দিনে ইসরাইলি আর্মির কাছে তিনটি আরব দেশের একসাথে পরাজয়। সেই যুদ্ধে মিশরের সিনাই প্রদেশ দখল করে নিয়েছিলো ইসরাইলিরা।
সুতরাং আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় বসে শুরু থেকেই চাপে ছিলেন। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সিনাই প্রদেশ ইসরাইলিদের হাত থেকে পুনরুদ্ধার করাটা জরুরী ছিল। ক্ষমতায় বসে সবার আগে আনোয়ার সাদাত রাষ্ট্রযন্ত্রে নিজের অবস্থান মজবুত করার দিকে নজর দিলেন। কাকতালিয়ভাবে তখনই আনোয়ার সাদাতের কাছে দেখা করতে এলেন আশরাফ মারওয়ান।
সাথে নিয়ে এলেন কিছু কাগজ। তাতে ছিল নামের তালিকা। যারা যারা আনোয়ার সাদাতের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যাদের যাদের ১০০% লয়ালিটি নেই আনোয়ার সাদাতের উপর, তাদের একটা লিস্ট।
লিস্ট পেয়েছিলো সম্ভবত নাসেরের ব্যক্তিগত কোনো আর্কাইভ ঘেটে। তাতে তথ্য প্রমানও ছিল। সম্ভবত জীবন অবস্থায় নাসের নিজের অধিনস্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি করতেন। সেগুলোরই রিপোর্ট।
আনোয়ার সাদাত খুশি হলেন। এবং সেই লিস্ট ধরেধরে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা এবং আর্মি অফিসার ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাগুলোকে গ্রেফতার করে জেলে ভরলেন এবং নিজের লয়ালিস্টদের পদে বসালেন।
মারওয়ানকে পুরস্কার হিসেবে দিলেন নিজের প্রেসিডেন্টসিয়াল অফিসের চিফ অফ স্টাফ। সেইসাথে ইনার সার্কেলের সদস্য বানালেন।
জীবনে প্রথমবারের মত মারওয়ান মিশরের রাষ্ট্রযন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে গেলেন। এরপর ধীরে ধীরে হয়ে গেলেন আনোয়ার সাদাতের অন্যতম বিশ্বস্ত ব্যক্তি।
প্রায়সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার টেবিলেই সাদাতের সঙ্গে থাকতেন মারওয়ান। সাদাতের সাথে যেতেন ফরেন ট্যুরে। ডেলিগেটস হিসেবে। সাদাতের হয়ে বিশেষ দূত হিসেবে ফরেন মিশনে যেতেন তিনি।
যেমন উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ছিল লিবিয়ান মিশন। লিবিয়ার সেইসময়কার ডিক্টেটর কর্নেল গাদ্দাফির সাথে ডিলিংস করতে মারওয়ানকে লিবিয়াতে পাঠানো হয়েছিল। মিশরের সাথে লিবিয়ার সম্পর্ক উন্নয়নে মারওয়ানের ভুমিকা ছিল।
মারওয়ান কাজ করতেন মিশরীয় ডিপ্লোমেট হিসেবে।
ওদিকে সকল তথ্য পাচার করে দিতেন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। মোসাদের অফিসার Danny Ben Aroya ছিল মারওয়ানের হ্যান্ডেলার। আর সেইসময় মোসাদের চিফ ছিল Zvi Zamir
আশরাফ মারওয়ানের কোডনেম ছিল The Angel.
এদিকে আনোয়ার সাদাত ক্ষমতায় বসেই সিনাই প্রদেশ ইসরাইলিদের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার জন্য চেষ্টা শুরু করেন। প্রথমে ডিপ্লোমেটিক উপায়ে চেষ্টা চালান।
সাদাত ভালো করেই জানতেন, ইসরাইলিদের মার্কিন ব্যাকিং আছে। ইসরাইলকে ধ্বংস করা পসিবল না, তবে একটা যুদ্ধ করে সিনাই প্রদেশ পুনরুদ্ধান করাটা সম্ভব। এবং এজন্য দরকার অস্ত্র। আর সেই অস্ত্র আসবে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে।
এবং সেটাই হল।
সেইসময়কার সফিস্টিকেটেড এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করা হল সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে। সেইসাথে এন্টি ট্যাংক ওয়েপেন কেনা হল লেটেস্ট মডেলের।
যুদ্ধ শুরু হওয়াটা ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু প্রশ্ন হল, কখন যুদ্ধ শুরু হবে?
আর এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা ইসরাইলিদের আগেভাগেই জানিয়ে দিয়েছিলো আশরাফ মারওয়ান।
১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাস। ইহুদিদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান Yom Kippur এর দিনে মিশরীয় আর্মি সুয়েজ খাল অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে সিনাই প্রদেশে। পবিত্র ধর্মীয় দিনে ইসরাইলিরা উৎসবে মেতে ছিল। সিনাই প্রদেশ পাহারা দেবার জন্য ছিল মাত্র ৪৫২ জন ইসরাইলি সেনা।
ওয়েট !!!
আগেই না বললাম, মারওয়ান আগেভাগেই ইসরাইলিদের জানিয়ে দিয়েছিলো। তাহলে ইসরাইলিরা এলার্ট ছিল না কেন?
উত্তর সহজ।
এসেট সেভিং। অর্থাৎ ওইদিন যদি ইসরাইলিরা এলার্ট থাকতো, তাহলে মিশরীয় আর্মি ভালভাবেই বুঝে যেতো, যুদ্ধের পরিকল্পনা কেউএকজন তাদেরকে বলে দিয়েছে।
সুতরাং মারওয়ানের কাছে পাওয়া তথ্য ইসরাইলিদের কাছে ছিল। ইসরাইলিরা পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল, সেটা বলা যাবে না।
কারণ সেইসময় হরহামেশা যুদ্ধের আওয়াজ উঠতো, কিন্তু হতো না। সুতরাং মারওয়ানের দেয়া তথ্য নিয়ে সেইসময়কার ইসরাইলি হর্তাকর্তারা কিছুটা সন্দিহান ছিল।
তবে যদি সন্দিহান নাও থাকতো, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় যে সেদিন ইসরাইলিরা সিনাই প্রদেশে সুয়েজখালের অপরপাশে বিশাল সৈন্য মজুদ কখনোই করতো না। কারণ তেমনটা করলে মিশর বুঝে যাবে, ইসরাইলি গোয়েন্দাদের কোনোএক স্পাই তাদের ভেতরেই লুকিয়ে আছে।
তো যাই হোক, Yom Kippur War শুরু হল ৬ই অক্টোবর।
একই সময়ে মিশর এবং সিরিয়া, দুইদেশ মিলে ইসরাইলে বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো।
প্রায় এক লক্ষ মিশরীয় সেনা সুয়েজ খাল ক্রস করে গেল। ওপাশে গিয়ে পেল মাত্র ৪৫২ জন ইসরাইলি সেনা। ইসরাইলিদের কচুকাটা করা হল। অনেকে গ্রেফতার হল। মিশরীয় আর্মি সিনাই মরুভুমির ভেতর প্রবেশ করলো।
পরের ইতিহাস অবশ্য যুদ্ধের ইতিহাস। ওসব আর এখানে বলবো না।
শর্টকাটে বলি।
প্রথমদিকে সোভিয়েত স্কার্ড মিসাইল আর সোভিয়েত এন্টি ট্যাংক অস্ত্রের কারনে মিশরীয়রা বেশ দাপটের সাথেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ইসরাইলি আর্মি এসে তাদের পাল্টা আঘাত শুরু করে। এবং সুপিরিয়ন মিলিটারি স্ট্রাটেজি এবং ভালো ব্যাটল ট্যাংক এবং সেইসাথে মার্কিন ব্যাকিং, এসবের কারণে দ্রুতই মিশরীয়দের আবার পাল্টা আঘাত করে রীতিমত কোনঠাসাই শুধু হয়, উল্টা এরিয়েল শ্যারনের বাহিনী সুয়েজ খাল পার হয়ে মিশরের ভেতর ঢুকে পড়ে।
আর ওদিকে সিরিয়ানরা অল্প কিছুদিনের ভেতরই হারতে শুরু করে। উল্টা সিরিয়াকে রক্ষা করার জন্য তখন ইরাকি আর্মি সিরিয়াতে গিয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।
যাই হোক, এই যুদ্ধে এরিয়েল শ্যারন হিরো হয়ে যায়। এবং অনেক পরে গিয়ে তিনি ইসরাইলের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন।
ফিরে আসি,
আশরাফ মারওয়ান প্রসঙ্গে।
এই যুদ্ধে আশরাফ মারওয়ানের সরবরাহ করা ইন্টেলিজেন্স বেশ ক্রুশাল প্রমানিত হয়।
তবে এই ইনফরমেশনকে গুরুত্ব দিয়ে যথাযথ স্টেপ নিতে খামখেয়ালিপনার কারণে যুদ্ধ জয়ের পরও ইসরাইলিরা তাদের মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, আমান-এর প্রধান এলি জেইরা’কে বরখাস্ত করে।
১৯৭৩ সালের যুদ্ধের পর ইসরাইলিদের কাছে মারওয়ানের গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। মারওয়ানের সিক্রেট গোপনই থেকে যায়। মিশরের হয়ে কাজ করে যেতে থাকেন মারওয়ান।
যুদ্ধের পর তিনি মিশরের পররাষ্ট্র বিষয়ক সচিবের দায়িত্ব পান। এবং মিশর ইসরাইলি শান্তি আলোচনাতেও কনট্রিবিউট করেন।
১৯৭৬ সালে মিশরের কায়রো’তে Arab Organization for Industrialization নামের মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক তৈরি হয় সৌদি, কাতারি আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফান্ডিংএর টাকায়। মারওয়ান হয়ে যান সেটার প্রধান কর্মকর্তা।
এরপর ১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতের মৃত্যুর পর মিশর থেকে লন্ডনে পাড়ি জমান মারওয়ান।
সেখানে শুরু করেন ব্যবসা। ১৯৯৫ সালে চেলসি ফুটবল ক্লাবের ১৫ লক্ষ শেয়ারের মালিক ছিল মারওয়ান।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ইসরাইলিদের হয়ে কাজ করে যান মারওয়ান। এরপর নেন অবসর।
তার এই এস্পিওনাজ এক্টিভিটির ব্যাপারে গোটা দুনিয়া অজ্ঞাত ছিল। ২০০২ পর্যন্ত।
২০০২ সাল পর্যন্ত মারওয়ানের পরিচয় ছিল একজন সাবেক মিশরীয় পলিটিসিয়ান হিসেবেই।
যিনি মিশরের সাবেক প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দেল নাসের মেয়ের জামাই এবং মিশরের বড়বড় পদে কর্মরত ছিলেন এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মিশরীরা তাকে হিরো হিসেবেই দেখতো। ইনফ্যাক্ট এখনো দ্যাখে।
২০০২ সালে বাধে ঝামেলা।
Ahron Bregman নামের এক ইসরাইলি ইতিহাসবিদ একটি বই প্রকাশ করেন। নাম, A History of Israel.
এই বই লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই অনেক গবেষনা করেছিলেন। অনেক রেফারেন্স ঘেটেছিলেন।
এসব রেফারেন্সের ভেতর একটি ছিল মেজর জেনারেল এলি জেইরা’র লিখা একটি বই। উপরে বলেছিলাম, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধ জয়ের পরও ইসরাইল তার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আমান-এর প্রধান মেজর জেনারেল এলি জেইরা’কে বরখাস্ত করেছিলো ইন্টেলিজেন্সকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হবার দায়ে।
তো এই বরখাস্ত হওয়া সামরিক কর্মকর্তা একটি বই লিখেছিল যুদ্ধের বছর দশেক পর।
তাতে তিনি এক ডাবল এজেন্টের ব্যাপারে বেশকিছু কথা লিখেছিলেন। নাম উল্লেখ না করে। তার দাবি ছিল, ইসরাইলিদের শ্রেষ্ঠ স্পাই ছিল মুলত ডাবল এজেন্ট। যে কিনা ইসরাইলিদের মিথ্যা, ভুলভাল তথ্য দিতো ডিসিভ করার জন্য।
এলি জেইরা উনার বই’তে সেই ডাবল এজেন্টের নাম উল্লেখ না করলেও কিছু clue রেখে দিয়েছিলেন।
সেইসব clue নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করেন ইসরাইলি ইতিহাসবিদ এহরন ব্রেগম্যান। আগেই বলেছি, যিনি একটি বই লিখার জন্য নানান রেফারেন্স ঘাটাঘাটি করছিলেন।
তো ব্রেগম্যান এবার এই ডাবল এজেন্টের পরিচয় রিভিল করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।
এবং নানান কাহিনী করে অবশেষে তিনি সেই কথিত ডাবল এজেন্টের পরিচয় বের করতে সফল হন। তিনি হলেন আশরাফ মারওয়ান। কিন্তু পরিচয় নিজেনিজে উদ্ধার করা, আর সেটাকে প্রতিষ্ঠিত করা এক জিনিস নয়।
তো এহরন ব্রেগম্যানের বই’তে আশরাফ মারওয়ানের এস্পিওন্যাজ কাজকর্মের কথা আবার নতুনভাবে উঠে আসে।
নতুনভাবে আবার ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের প্রসঙ্গে উঠে আসে।
আগেই বলেছিলাম,
১৯৭৩ সালে যুদ্ধ জয়ের পরও ইসরাইল তার মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আমান-এর প্রধান মেজর জেনারেল এলি জেইরা’কে বরখাস্ত করেছিলো ইন্টেলিজেন্সকে গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হবার দায়ে। তো এলি জেইরা এবার বুড়ো বয়সে টক’শো গুলোতে মারওয়ানকে “ডাবল এজেন্ট” হিসেবে উল্লেখ করতে শুরু করেন।
কিন্তু চিন্তা করেই দেখুন, ইসরাইলের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের শ্রেষ্ঠ এজেন্ট যদি “ডাবল এজেন্ট” হয়, তাহলে সেটা ইসরাইলের জন্য রীতিমত অপমানজনক।
তো এজন্য সেইসময়কার মোসাদ প্রধান জাভি জামির এবার টক শো’তে এসে পাল্টা চিল্লাপাল্লা শুরু করে।
তিনি বলেন, এলি জেইরার মাথা খারাপ। সে বরখাস্ত হয়েছিলো নিজ দোষে। নিজের ভুলের দায় ঢাকতে বলির পাঠা খুজতেছে। এজন্য মারওয়ানকে ডাবল এজেন্ট বলে প্রচার রটাচ্ছে। অর্থাৎ মারওয়ানকে ডাবল এজেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করলে নিজের ব্যর্থতা কমানো যায়। আফটার অল, ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মারওয়ানের প্রভাইডেড ইনফরমেসন ইসরাইলিদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করেছিলো।
তো সেইসময়কার মোসাদ এজেন্ট জাভি জামির এবং আর্মি ইন্টেলিজেন্স চিফ এলি জেইরার টক’শো চিল্লাপাল্লা বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়।
মোসাদ দেখলো, এই ব্যাপারটা ডিসপিউট করা দরকার। অন্যথায় কাদা ছুড়াছুড়ি বাড়বে, এবং এই দুই বয়স্ক লোক বেখালে টক’শোতে সেন্সেটিভ ইনফরমেসন লিক করবে।
তো মোসাদ এই প্রবীন দুই সেনা কর্মকর্তাকে আর্বিট্রেশনের জন্য বসিয়ে দেয় এক বিচারকের সামনে। মীমাংসার জন্য ডেকে আনা হয় সেই ইসরাইলি ইতিহাসবিদ এহরন ব্রেগম্যানকে।
তো বিচারক একটা লিখিত পাঁচ পেজের রায় দেয় এবং এই বিরোধ নিষ্পত্তি করে। সেই লিখিত পেজে আশরাফ মারওয়ানকে ইসরাইলের এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং ইসরাইলের সবচেয়ে সফল স্পাই হিসেবেই উল্লেখ করা হয়।
ইসরাইলি বিচারক এই রায়টি লিখার সময় সুদূর প্রসারী কনসিকুয়েন্স চিন্তা করেননি।
কারণ কোনো লেখক নিজের বই লিখে যদি কাউকে ইসরাইলি স্পাই হিসেবে জাহির করে, সেটা এক জিনিস। আর ইসরাইলি কোর্টে কোনো বিদেশী ব্যক্তিকে ইসরাইলি এজেন্ট হিসেবে উল্লেখ করে রায় লিখা, সেটা আরেক জিনিস।
মিশরের পত্রপত্রিকায় এই রায় ছাপা হয় কিছুদিনের ভেতরই। রাতারাতি অনেকের কাছে ভিলেন হয়ে যায় আশরাফ মারওয়ান।
এবার আসে মিশরীয়দের ভিন্ন ধরণের বিবৃতি।
এবার মিশরীয়রা দাবি করে, আশরাফ মারওয়ান মূলত তাদেরই এজেন্ট ছিল। আনোয়ার সাদাতের নির্দেশেই সে ইসরাইলিদের সাথে যোগাযোগ করেছিল।
এবং ভুলভাল তথ্য দিয়ে ইসরাইলিদের বিভ্রান্ত করা ছিল তার উপর দায়িত্ব।
মিশরীরা তাদের মত লজিক দেখিয়েছে।
তবে আমি মনে করি, এটা দেখানো স্বাভাবিক। কারণ গামাল আব্দেল নাসের পরিবারের সদস্য, অর্থাৎ তার মেয়ের জামাই ছিল ইসরাইলি গুপ্তচর, এই তথ্যটা প্রতিষ্ঠিত হলে সেটা হবে মিশরের জন্য চরম লজ্জার। অপমানের।
চিন্তা করেই দেখুন, আগামীকাল যদি শুনতে পান, আপনার দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর সন্তান বা মেয়ের জামাই বাইরের কোনো দেশের গুপ্তচর, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই সেটা হবে চরম হিউমিলিয়েশন।
ব্যাপারটা তেমনই।
তো হিউমিলিয়েশন ঠেকাতে আপনি যেটা বলতে পারেন, সেটা হল অভিযুক্ত ব্যক্তি মুলত “ডাবল এজেন্ট” অর্থাৎ ওদের হয়ে কাজ করেছে বলে ওরা মনে করেছে, কিন্তু মুলত কাজ করেছে আমাদের হয়ে। ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ।
আশরাফ মারওয়ানের স্ত্রীও টিভি সাক্ষাৎকার দিয়ে বলতে শুরু করেন, তিনি মারওয়ানের ব্যাপারে সবকিছুই জানতেন। মারওয়ান দেশের জন্য কাজ করতেন। ডাবল এজেন্ট হিসেবে ইসরাইলিদের মিসইনফর্মেসন দিতেন। ব্লাহ ব্লাহ ব্লাহ।
(***আফটার অল, কোনো মহিলা কি চায় দেশোদ্রোহীর বঊ ট্যাগ খেতে? সুতরাং উনার এসব বলাটা স্বাভাবিক। )
যাই হোক, ইসরাইলিরা আশরাফ মারওয়ানকে নিজেদের হিরো হিসেবেই দ্যাখে। এবং মোসাদের ইতিহাসে সবচেয়ে হাই প্রোফাইল এজেন্ট।
কিন্তু খেয়াল করুন।
এমনও তো হতে পারে, আশরাফ মারওয়ান সত্যিসত্যিই একজন ডাবল এজেন্ট ছিল ! যদি সেটা হয়, তাহলে আশরাফ মারওয়ান ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ডাবল এজেন্ট। কারণ ইসরাইলি গোয়েন্দা বাহিনীকে ভুলভাল বুঝিয়ে এতোদিন টিকে থাকা, এটা কল্পনা করাটাও কঠিন। যেমন, ৬ই অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে সন্ধ্যা বেলা মিশর সিনাই প্রদেশে আক্রমন করবে বলেই ইসরাইলিদের ইনফর্ম করেছিলো আশরাফ মারওয়ান। যদিও ইসরাইলিরা আক্রমন করেছিলো দুপুরে।
তবে এটা আশরাফ মারওয়ানকে ডাবল এজেন্ট প্রমান করার জন্য শক্ত কোনো যুক্তি নয়। কারণ দিনশেষে ইহুদিদের ধর্মীয় ছুটির দিন ঠিকই আক্রমন করেছিলো মিশর। হয়ত মাত্র চার পাঁচ ঘন্টা আগে। তবে এটা বড় কোনো ইস্যু নয়।
যদি ডাবল এজেন্ট না হয়ে, শ্রেফ “ইসরাইলি এজেন্ট” হয়, সেটাও চিন্তা করলে অবাক লাগে। কারণ মিশরের এতো বড়বড় পদে আসীন থাকা অবস্থায় দিনের পর দিন ইসরাইলিদের হয়ে কাজ করে যাওয়াটা চারটিখানি কথা না। তাও আবার খোদ প্রেসিডেন্টের ইনার সার্কেলের সদস্য হয়ে !!
ভাবলে অবাকই লাগে।
যাই হোক, ২০০২ সালে নাটকীয়ভাবে আশরাফ মারওয়ানের এস্পিওন্যাজ কাজকর্মের কথা রিভিল হয়ে গেল তার জীবন ঝুকির মুখে পড়ে যায়। কারণ যদি সে সত্যিসত্যিই ডাবল এজেন্ট হয়, তাহলে ইসরাইলিরা তাকে মেরে ফেলবে। আবার যদি শ্রেফ “ইসরাইলের মোসাদ এজেন্ট” হয়, তাহলে মিশরীয়রা তাকে হত্যা করবে। প্রতিশোধ নেবে। পাবলিক্যালি স্বীকার করে তার বিরুদ্ধে কথা না বললেও গোপনে ঠিকই তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের মিশনে নামবে।
যেই লেখক অর্থাৎ এহরন ব্রেগম্যান লন্ডনেই থাকতেন।
আশরাফ মারওয়ানের সাথে তিনি যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত একসময় আশরাফ মারওয়ানের সাথে খাতির জমিয়ে তোলেন তিনি।
সেইসাথে আশরাফ মারওয়ানের কাছে ক্ষমাও চাইলেন। কারণ তার কারনেই আশরাফ মারওয়ানের সিক্রেট ফাঁস হয়ে গেল এবং জীবন হুমকির মুখে পড়ে গেল।
তো জীবনের শেষদিকে আতঙ্কের ভেতরই থাকতেন আশরাফ মারওয়ান।
লেখক এহরন ব্রেগম্যান উনার বন্ধু হয়ে গেলেন। ব্রেগম্যান মারওয়ানের সাথে নিজের কথোপকথন রেকর্ড করতেন। ২৭ জুলাই, ২০০৭ সালের এক বিকেল বেলা ব্রেগম্যানের সাথে মারওয়ানের ঘুরতে যাবার কথা ছিল।
কিন্তু সেদিন লন্ডনের এপার্টমেন্টের ব্যালকনি থেকে পড়ে মৃত্যু হয় মারওয়ানের। কেউ বলে হত্যা, কেউ বলে সুইসাইড। স্কর্টল্যান্ড ইয়ার্ড এটাকে হত্যা বলে সন্দেহ করে। ইনভেস্টিগেশন আজও চলমান। মারওয়ান যেদিন ব্যালকনি থেকে পড়ে যায়, সেদিন পাশের এপার্টমেন্টের এক প্রতিবেশি মারওয়ানের ব্যালকনিতে দুজন মিডিল ইস্টার্ন ব্যক্তিকে দেখেছিলেন বলে বিবৃতি দেন। এতে রহস্য আরো ঘনিভুত হয়।
সেইসময় কেবল মারওয়ান নয়, ঠিক একইভাবে লন্ডনে বসবাসরত তিনজন মিশরীয় ব্যক্তিত্বের মৃত্যু হয় যারা ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মিশরে আলোচিত ছিলেন এবং মিশরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। যারা হলেন, actress Suad Hosni; Egyptian ambassador to Greece Al-Leithy Nassif and Ali Shafeek, secretary in the office of former Egyptian Vice President Abdel Hakim Amer
মারওয়ানের মৃত্যুর পর মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক বিবৃতি দেন, "Marwan carried out patriotic acts which it is not yet time to reveal."
অর্থাৎ ইন পাবলিক, তিনিও মারওয়ানকে ডাবল এজেন্ট হিসেবেই জাহির করেছেন।
মারওয়ানের মৃতদেহ মিশরে এনে যথেষ্ট মর্যাদা দেখিয়েই দাফন করা হয়। ইসরাইলিরা ব্যাপারটাকে হাস্যকর হিসেবেই দেখেছে। অর্থাৎ গডফাদার মুভির মত।
মাফিয়ারা যেমন নিজের ফ্যামিলির কেউ বেইমানি করলে নিজেরা খুন করে জনসম্মুখে আবার নিজেরাই কান্নাকাটি করে ফিউনারেল করে, ব্যাপারটা তেমনই।
অর্থাৎ সত্য মিথ্যা যেটাই হোক, মিশরীয়দের কাছে মারওয়ানের ইমেজ ম্যাটার করে। মারওয়ানকে ইসরাইলি এজেন্টি হিসেবে মেনে নেওয়াটা হল রাষ্ট্রীয় হিউমিলিয়েশন। ব্যাপারগুলো আগেই বুঝিয়েছি।
মারওয়ানের মৃত্যুর পর ইসরাইলি সাবেক মোসাদ চিফ জাভি জামির বলেছিলেন,
“আমার যদি ক্ষমতা থাকতো, আমি মিশরে গিয়ে প্রতিদিন মারওয়ানের কবরে একটা করে ফুল রেখে আসতাম”
মারওয়ানকে ইসরাইলিরা তাদের বেস্ট স্পাই মনে করে। আবার মিশরীয়রাও হিরো মনে করে।
সত্য যেটাই হোক,
মারওয়ান একজন দূর্ধর্ষ স্পাই ছিল, তাতে সন্দেহ নেই।
মারওয়ানের স্পাই এক্টিভিটির উপর The Angel নামের একটা মুভি আছে।
এছাড়া এহরন ব্রেগম্যান একটি বই লিখেছেন পরে।
নাম The Spy Who Fell to Earth: My Relationship with the Secret Agent Who Rocked the Middle East