Sunday, January 14, 2018

মসনদের রাজনীতি -১০১ (ক্লাস-১)



ক্ষমতা কি জিনিস?
ক্ষমতার মসনদে গেলে মানুষ কেন বদলে যায়?
আসুন, আমরা ক্ষমতাবানদের বোঝার চেষ্টা করি লেখক ব্রুস ব্রুনোর চোখে এবং বিশ্লেষণের মধ্যদিয়ে।
Bruce Bueno de Mesquita is a political scientist,
professor at New York University, and senior fellow at Stanford University's Hoover Institution.

একটি রুলস সবার আগে বিবেচনায় রাখুন।
ক্ষমতায় যাবার আগে যারা চিন্তা করে কিভাবে ক্ষমতায় যাবো,আবার ক্ষমতায় বসার পর তাদের চিন্তা শুরু হয়, কিভাবে ক্ষমতায় থাকবো।
এই চিন্তা সর্বদা তাদের ব্যস্ত রাখবে। রাখবেই রাখবে।

আপনি ভুলেও ভাববেন না, নর্থকোরিয়ার নেতা কিম জন উনের ক্ষমতা হারানোর ভয় নেই। অবশ্যই আছে।
ক্ষমতা হারানোর ভয় যেমন জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেলের আছে,
তেমন কিম জন উনেরও আছে।

কিন্তু এখানে একটা জিনিস খেয়াল করেন।
জার্মানির নেতা এঙ্গেলা মার্কেল
আর নর্থ কোরিয়ার নেতা কিম জং উন,
দুজনের ক্ষমতার ধরণ আলাদা।

মার্কেল একটি গনতান্ত্রিক দেশের নেত্রী। জার্মানিতে সত্যিকার অর্থেই গনতান্ত্রিক চর্চা বিদ্যমান।
মার্কেল ক্ষমতা থেকে নামবে নির্বাচনে হেরে। (মারা গেলে ভিন্ন হিসাব)
মার্কেল ক্ষমতা থেকে নামলে তাঁর আহামরি খারাপ তেমনকিছুই হবে না। হয়ত দুর্নীতি করে থাকলে নেক্সট সরকার এসে সেই দুর্নীতির তদন্তে নামবে। মার্কেলকে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে। এই যা।
মার্কেল ক্ষমতা থেকে নামলে তিনি “জার্মান চ্যান্সেলর” থেকে একজন “সাধারণ নাগরিক” হয়ে যাবেন।

কিন্তু কিম জং উন?
সে ক্ষমতা থেকে নামবে তখনই, যখন তাঁকে ক্ষমতা থেকে নামানো হবে জোর করে। হত্যা করা হবে সাদ্দামের মত অথবা জেলে ভরা হবে।
যে পদের ক্ষমতা যত বেশি, সেই পদ ততবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এবং ক্ষমতা হারানোর ভয়ও ততবেশি।
জার্মানিতে মার্কেল যে পরিমাণ ক্ষমতাবান,
কিম জং উন উত্তর কোরিয়াতে আরো বেশি ক্ষমতাবান।
জার্মানিতে মার্কেল যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। ইচ্ছা হলে দশটা মানুষকে মেরে ফেলার ক্ষমতা মার্কেলের নেই। মার্কেলের ক্ষমতা জার্মানির সাংবিধানিক রুলস এন্ড রেগুলেশনে বাধা।
মার্কেল যেটা করেন, সেটা সাংবিধান চাকরি।
কিন্তু উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম?
সে তো উত্তর কোরিয়াতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি। যা ইচ্ছা করতে পারে সে। উনার উপর কথা বলার সাহস কারো নেই। উনার আদেশ যেটাই হোক, মেনে চলতে হবে সবাইকে।

আর এজন্যেই কিম জং উনের ক্ষমতা যেমন বেশি, ঠিক তেমনই ক্ষমতা হারানোর ভয় বা প্যারানোয়া জার্মানির মার্কেলের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বহুগুণ বেশি। আর ক্ষমতা হারালে পরিনতিও ভয়াবহ।
আর এজন্য ক্ষমতার প্রতি হুমকি হতে পারে, এমন কোনোকিছুকেই তিনি স্বাভাবিকভাবেই টলারেট করেন না।

নানান দেশে নানান ধরণের শাসন ব্যবস্থা চলতেছে। কোথাও গনতন্ত্র, কোথাও সামরিক সরকার, কোথাও একনায়কতন্ত্র, কোথাও রাজতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র,
নানান ধরণের শাসন ব্যবস্থা চলতেছে।
কনভেনশন্যাল উইজডম অনুসারে আমরা নর্থ কোরিয়ার নেতা কিম জং উন’কে একজন ডিক্টেটর বা একনায়ক হিসেবেই চিনি।

তবে শাসনব্যবস্থা যেমনই হোক,
একটা জিনিস সবার আগে মনে রাখতে হবে,
No Leader Can Lead Unilaterally. No Leader is monolithic.

অর্থাৎ একাএকা কোনো লিডারের পক্ষেই দেশ চালানো সম্ভব না। সেটা অতীতের হিটলার বা জোসেফ স্তালিনের জন্যেও সমান সত্য ছিল।
ঠিক একইভাবি সত্য কিম জং উনের জন্যেও।
আমরা কেবল ক্ষমতার মসনদে বসা ব্যক্তিটিকেই দেখি।
ক্ষমতার মসনদটিকে যেসব স্তম্ভগুলো সাপোর্ট দিয়ে ধরে রাখে, সেগুলোকে দেখিনা।
প্রফেসর ব্রুসের লিখা “dictator's Handbook” বইটিতে প্রথমেই আলোচনায় এসেছে মসনদের এই স্তম্ভগুলো।
তিনি গনতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ধনতন্ত্র, Oligarchy, মেরিটোক্র্যাসি সহ আরো যতধরণের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে,
সবগুলোর ভেতর একটা কমন সিনারিও তুলে ধরেছেন। এসব গতানুগতিক ক্লাসিফিকেশন বাদ দিয়ে তিনি বলেছেন, ক্ষমতার মসনদে যে বা যারাই বসুক,
তাঁদের বা তাঁকে মুলত তিন শ্রেণীর মানুষ ডিল করতে হয়।
১. ইনফ্লুয়েন্সিয়াল (Influential) / প্রভাবশালী
২. এসেন্সিয়াল (Essential) / অপরিহার্য
৩. ইন্টারচেঞ্জেবল (interchangeable) / বিনিমেয়

তো প্রভাবশালী শ্রেনী কারা?
আমরা গতানুগতিকভাবে যাদেরকে প্রভাবশালী বলি। সেই প্রভাবশালীদের বোঝাচ্ছেনা এখানে।
এখানে প্রভাবশালী শ্রেনী বলতে তাঁদেরকে বোঝানো হচ্ছে, যাদেরকে মসনদে বসে আপনার “নিয়ন্ত্রণে” রাখতে হবে এবং যারা আপনাকে “ক্ষমতা থেকে নামানোর ক্ষমতা” রাখে।
এই জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
একটি দেশের সামরিকবাহিনী এই শ্রেণীর অন্তর্গত। সেইসাথে ফরেন ব্যাকার, তথা “বিদেশী প্রভু”রাও এই শ্রেনীতে পড়ে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হবে।
মিশরের আরব বসন্তের কথা চিন্তা করুণ।
হোসনি মোবারকের তিন দশকের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হল। মানুষজন রাস্তায় নামলো। মিশরের তেহরির স্কোয়ার মানুষে ভরে গেল।
হোসনি মোবারক পুলিশ দিয়ে জনসমুদ্র নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলেন।
এরপর তিনি আর্মি নামালেন।
আর্মি ট্যাঙ্ক গোটা তেহরির স্কোয়ার ঘিরে ফেললো। কিন্তু মানুষের গায়ে একটি বুলেটও ছুড়লো না।
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ওদিকে মানুষের মিছিলে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে গেল। ট্যাঙ্কে বসা সেনারা কার্যত কিছুই করলো না।

অর্থাৎ?
অর্থাৎ বোঝা হয়ে গেল, হোসনি মোবারক ক্ষমতার মসনদের একটি গুরুত্বপূর্ণ Influential পিলার বা স্তম্ভ হারিয়ে ফেলেছেন। সেটা হল “আর্মি”
তখন বুঝতে আর বাকি রইলো না, মিশরের আর্মি এখন হোসনি মোবারকের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছে।
মিশরের রাজনীতি যারা পর্যবেক্ষণ করেন, তাঁরা ভালো করেই জানেন, মিশরের রাজণীতিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ রোল প্লে করে আর্মি আর আমেরিকা।
হোসনি মোবারক নিজেও একসময় বিমান বাহিনীর প্রধান ছিলেন।
তো আমেরিকা আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ Influential স্তম্ভ।
আর্মি যেহেতু মোবারকের উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, সেহেতু এটাও বোধগম্য, আমেরিকাও আর চাচ্ছে না হোসনি মোবারক ক্ষমতায় থাকুক।
সুতরাং ফলাফল কি?
ফলাফল হল, মোবারক’কে এখন ক্ষমতা থেকে নামতে হবে। ইশারা পরিস্কার।

তো মোবারক সত্যিসত্যিই ক্ষমতা থেকে নেমে গেল। আর্মি পুলিশ গিয়ে হোসনি মোবারককে গ্রেফতার করলো।
ওদিকে আমজনতা?
আমজনতা কিন্তু মহাখুশি।
আমজনতার ধারণা, তাঁদের গনআন্দোলন আর বিশাল মিছিলের ঠেলায় হোসনি মোবারকের পতন ঘটেছে। সুতরাং
গোটাবিশ্বে এবার নিউজ পেপারে হেডলাইন হইল,
“জনতার আন্দোলন তথা আরব বসন্তে মোবারক পদচ্যুত”

ওকে... ফাইন।
খুব ভালো কথা।
এরপর কি হল?
এরপর মিশরে ফ্রি ফেয়ার ইলেকশন হইলো। কে জিতলো?

জিতলো, মুসলিম ব্রাদারহুড।
খোদ আর্মির পরোক্ষ তত্ত্বাবধানেই নির্বাচন হয়েছিলো। মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি পেল ৫১.৭৩% ভোট।
মোহাম্মদ মুরসি হল প্রেসিডেন্ট।
কিন্তু এখানে তো সমস্যা। এই মুসলিম ব্রাদারহুডকে দুচোখে দেখতে পারে না আমেরিকা আর আর্মি। এই দুইটা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল স্তম্ভ একবছর যেতে না যেতেই ঠিকই মুরসির পতনের আয়োজন করলো।
কি হল এরপর?
আবার মিশরের তেহরির স্কোয়ারে আন্দোলন শুরু হল। এবার দাবি, মুরসি’কে ক্ষমতা থেকে নামাও। এরা মুলত এন্টি ব্রাদারহুড জনতা।
আবার ঠিক তখন মিশরের বড়বড় শহরগুলো ব্রাদারহুডের সমর্থকদের বিশাল মিছিল, তাদের দাবি, মুরসিকে ক্ষমতায় রাখো।

ব্যস, এবার আবার আর্মি নামলো। মুরসিকে গ্রেফতার করলো এবং হা... মুরসির সমর্থকদের উপর আর্মি নির্বিচারে গুলি চালালো। Rabaa স্কয়ারে গোলাগুলিতে বহুমানুষ মারা গেল।
কত মানুষ মারা গিয়েছিল, সঠিক হিসাব নেই।

ঠিকই মিশরকে রক্তে ভাসিয়ে এবার আর্মি ক্ষমতা নিয়ে নিলো।



ব্রাদারহুড আর এন্টি ব্রাদারহুড,
দুইগ্রুপই এবার আর্মির গুলির ভয়ে জীবন বাঁচাতে ঘরে ফেললো।
সেই হতে আমেরিকান ব্যাকিং নিয়ে আব্দুল ফাতাহ আল সিসি মিশরের ক্ষমতায়।
হোসনি মোবারক গেল। সিসি এলো।
মিশর সেই আগের মতই ডিক্টেটরশিপের আন্ডারেই রয়ে গেল।
এখন যদি সিসি’র পদত্যাগের দাবিতে কোনো মিসিল হয় তেহরির স্কোয়ারে,
নিশ্চিত থাকুন, আর্মি এসে গুলি করে ঝাঁজরা করে দেবে। কেউকিছু বলবে না। আমেরিকাও চুপ করে থাকবে।

সুতরাং বুঝতেই পারতেছেন, ইনফ্লুয়েন্সিয়াল বা প্রভাবশালী শ্রেনীকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে আপনার ক্ষমতার গদী নড়ে যাবে। ফলাফল,
এই শ্রেনীকে চেকইনে রাখতে হবে।
তাঁদের সুযোগসুবিধা দিতে হবে।

যেমন, আমি নাম নিচ্ছি না, এমন অনেক গনতান্ত্রিক দেশ আছে, যে দেশের আর্মিরা প্রচুর ফরেন মিশনে যায়। জাতিসংঘের পিস মিশন, আফ্রিকান মিশন, এটা সেটা, নানান মিশনে যায়। সরকার এসব সুযোগ সুবিধা করে দেয়।
এসব বিদেশি মিশনের সিংহভাগ ডোনেশন দেয় আমেরিকা আর পশ্চিমা দেশগুলো।
সুতরাং আমেরিকা আর পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সরকারের যদি সম্পর্ক ভালো থাকে, তাহলে আর্মি সুযোগসুবিধা নিয়েই চুপ থাকবে। ক্ষমতা দখল করার চিন্তা সহজে করবে না। কারণ ক্ষমতা দখল করলে পশ্চিমারা রেগে যাবে। তখন মিশনে কর্মরত সেনাদের ফিরিয়ে দেবে। ফরেন মিশনে সেনা নেয়া বন্ধ করে দেবে। ফলাফল, যে আর্মি পারসন ক্ষমতা দখল করবে, তার বিপক্ষে খোদ আর্মির ভেতরেই অসন্তোষ তৈরি হবে। কেউ কি চায় নিজেদের পেটে লাথি মারতে?
সুতরাং আর্মি ক্ষমতা নেবার আগে দশবার ভাববে।
তবে হা... যদি এমন পরিস্থিতি কখনো আসে, পশ্চিমারা নিজেরাই গ্যারান্টি দেয় আর্মিকে যে ক্ষমতা কেড়ে নিলেও সমস্যা হবে না, ইন দ্যাট কেস, আর্মির ভেতরে থাকা উচ্চভীলাসী সেনা কর্মকর্তারা হয়ত তখন ক্ষমতা দখলের ট্রাই করবে। অন্যথায় তেমনটি হবে না।

এই হিসাবটা আফ্রিকার দেশগুলোতে অনেকবেশি প্রচলিত আছে।


সুতরাং, ক্ষমতার মসনদে যে বসে থাকবে, তাঁকে সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে, এই প্রভাবশালী শ্রেনী অর্থাৎ ক্ষমতার ব্যাকার + ক্ষমতা কেড়ে নেবার ক্ষমতা যাদের আছে, তাঁদের বেশি পরিমাণ সুযোগসুবিধা দিয়ে শান্ত রাখতে।
সেইসাথে বেশি বিশ্বাসও করা যাবে না।
হোসনি মোবারকের কথা চিন্তা করুণ। তিন দশক কিন্তু ঠিকই ক্ষমতায় থেকেছিলো সে। কিন্তু একদিন না একদিন ঠিকই সমস্যা হবে।


যাই হোক...
এবার আসুন, এসেন্সিয়াল (Essential) / অপরিহার্য শ্রেনী।
এই শ্রেনীতে নানান কিসিমের, নানান ধরণের মানুষ থাকবে।
মসনদে যে বসে আছে, তাহার আপনজন, দলবল, প্রিয়জন, পুলিশ, আমলা, সরকারি বেতনভোগী ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, কর্মকর্তা সহ নানান পদের লোক।
অর্থাৎ দেশের + ক্ষমতার সিস্টেমটাকে সুন্দরমত সচল রাখতে যাদের লাগবে, তাহারা এই সিস্টেমে অন্তর্গত।
উন্নত দেশে বিজ্ঞানী + গবেষক + টেকনোক্রেটরাও এই শ্রেনীতে পড়ে।
যেমন হিটলারের সময়কার জার্মান নাৎসি অনুগত বিজ্ঞানী বা গবেষকদের কথা চিন্তাকরুণ। এরা কিন্তু হিটলারের ক্ষমতার প্রতি কোনো থ্রেট কখনো হবার ক্ষমতা রাখতো না। কিন্তু ছিল অপরিহার্য শ্রেনী।
এদেরকে ব্যবহার করে হিটলার জার্মানির সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছিলো নাটকীয়ভাবে।
অর্থাৎ,
সোজা কথা, শাসনযন্ত্র সুন্দরমত টিকিয়ে রাখতে যাদের দরকার হয়, তাহারাই এই শ্রেনীভুক্ত।
গোয়েন্দাবাহিনীও এই শ্রেনীভুক্ত।
যেমন আমেরিকা গোটা দুনিয়াতে তাঁর প্রভাব বজায় রাখতে সিআইএ ব্যবহার করে। ইনফরমেশন ইজ পাওয়ার। সিআইএ সেটা সরবরাহ করে।
তবে সোভিয়েত কেজিবি কিন্তু (Essential) / অপরিহার্য শ্রেনী ছিল না। বরং কেজিবি ছিল প্রভাবশালী বা ইনফ্লুয়েন্সিয়াল শ্রেণী।
কেজিবি একটা প্যারালাল সরকারের মত কাজ করতো এবং কেজিবির ক্ষমতা ছিল মসনদ বদলে দেবার। সুতরাং কেজিবি আলাদা হিসাব।

আগেই বলে নিচ্ছি, দেশ ভেদে হিসাবগুলো একটু বদলে যায়। তবে মোটামুটি সিনারিওতে মিল পাবেন।
সোজা হিসাব হল, এসেন্সিয়াল শ্রেণী জীবনে মসনদে বসতে পারবে না, কিন্তু শাসনতন্ত্র চালাতে হলে এই এসেন্সিয়াল শ্রেণীকে খুশি রাখতে হবে।
এরা ঠিকমত কাজ না করলে শাসকের জন্য নানান সমস্যা তৈরি হবে। কোনো শাসকই চাইবে না মসনদে বসে অশান্তিতে থাকতে।
সুতরাং সব প্রভাবশালী শ্রেণীর দাবিদাওয়া পুরনের পরই শাসক নজর দেবে অপরিহার্য শ্রেণীর দাবিদাওয়া, বেতনভাতা, আবাসন সুবিধা, এটাসেটা সহ ছোটখাটো নানান দাবিদাওয়া পুরন করতে।

এবার শেষ শ্রেণী হল, আমজনতা। অর্থাৎ ইন্টারচেঞ্জেবল (interchangeable) / বিনিমেয়
এরা না প্রভাবশালী, না অপরিহার্য।
তবে হা... ক্ষেত্র বিশেষে বা পেক্ষাপটভেদে এরা কখনো অপরিহার্য আবার কখনো খোদ প্রভাবশালীও হয়ে যেতে পারে, আবার অনেকসময় এদের মূল্য থাকে সবার পরে।
ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা না করে বললে বুঝবেন না।

যেমন, নর্থ কোরিয়ার কথা চিন্তা করুণ।
সেই দেশে কোনো গনতন্ত্র নাই। চলতেছে এবসোল্যুট ডিক্টেটরশিপ।
তো সেইদেশের প্রভাবশালী শ্রেণী হল নর্থ কোরিয়ার আর্মি + বিদেশী প্রভু “চীন”
কিম জং উনকে সবার আগে এই দুই শ্রেণীকে খুশি রাখতে হবে। নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে।
সুযোগসুবিধা দিতে হবে।
এরপর আসতেছে অপরিহার্য শ্রেণী, বা এসেন্সিয়াল।
যেমন কমিউনিস্ট পার্টি, আমলা, বিচারবিভাগ, পুলিশ, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার,
এসব।
এদেরকে সুযোগসুবিধা দিতে হবে। তাহলে অন্তত রিজিম ক্যালাপস করবে না।
এরপর সবার শেষে আসতেছে আমজনতা। বা ইন্টারচেঞ্জেবল।
এরা না খেয়ে মরলেও সমস্যা নেই। আমজনতাকে নানান উপায়ে ভুলিয়ে রাখা যায়, ম্যানুপুলেট করা যায়। দুর্ভিক্ষ হলেও নর্থ কোরিয়াতে সরকার পতন হয় না, কারণ প্রভাবশালী এবং অপরিহার্য শ্রেণী থাকে কিম পরিবারের পকেটে।
একই হিসাব জিম্বাবুয়ের রবার্ট মুগাবের জন্যেও প্রযোজ্য ছিল।
রবার্ট মুগাবে যুগের পর যুগ জিম্বাবুয়ে শাসন করেছে একটানা। এবং তাঁর শাসন আমলে অব্যবস্থাপনা চরমে উঠে গিয়েছিলো। জিম্বাবুয়ের মানুষ দিনকে দিন গরিব হয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে মুগাবে ছিল সফল। কারণ মুগাবে জানতো, ক্ষমতায় বসে থাকতে হলে কাদেরকে হাতে রাখতে হবে।
এবং মুগাবে ঠিক তাঁদেরই সুযোগসুবিধা দিতো।

ডিক্টেটরশিপ যে দেশে চলে, সেইদেশের প্রভাবশালী এবং অপরিহার্য শ্রেণীর আকার হয় অনেক ছোট। ওদিকে ইন্টারচেঞ্জেবল শ্রেণী বা আমজনতার আকার হয় অনেক বড়।
ফলাফল, রাষ্ট্রের কোষাগার থেকে সাপ্লাই হওয়া সুযোগসুবিধাগুলো প্রভাবশালী আর অপরিহার্য শ্রেণী অনেক বেশি ভোগ করে। (কারণ তাঁদের আকার ছোট)
সেইসাথে ডিক্টেটরও আমজনতার উপর ইচ্ছামত কর আরোপ করতে পারে। কারণ আমজনতা অসহায়। তাঁদের উপর বেশি কর আরোপ করে আরো বেশি টাকা তুলতে পারে এবং সেই টাকায় প্রভাবশালী এবং অপরিহার্য শ্রেণী আরো বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে।
সুতরাং হিসাবটা বুঝতে পারতেছেন।
প্রভাবশালী এবং অপরিহার্য শ্রেণীর জন্য ডিক্টেটরশিপ রীতিমত আশীর্বাদ।

অন্যদিকে যদি দেশে গনতন্ত্র থাকে, তাহলে কি হয় চিন্তা করুণ।
বিশাল পরিমাণ আমজনতা, অর্থাৎ ইন্টারচেঞ্জেবল শ্রেণী প্রতি চার বছর বা দেশভেদে পাঁচ বছর পরপর রীতিমত প্রভাবশালী শ্রেণীর ভুমিকাতে অবর্তীর্ণ হয়। ভোট দেয়। ভোট দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল করতে পারে।
সুতরাং ক্ষমতায় যে বসে, সে চিন্তা করে কিছুতেই এই আমজনতা বা ইন্টারচেঞ্জেবল শ্রেণীকে খ্যাপানো যাবে না। অন্তত সামান্যকিছু হলেও বা যতটুকু না হলেই না, ততটুকু সুযোগসুবিধা তাঁদের দিতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, রাস্তাঘাট, চালডাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাতির সাপ্লাই নিশ্চিত করতে হবে আমজনতার জন্য। এতে আমজনতা শান্ত থাকবে।
চার বছর বা দেশভেদে পাঁচ বছর পর ভোট হলে তখন আমজনতা যাতে ভোট দেয় অন্তত।
সেইসাথে জনতার উপর ইচ্ছামত কর আরোপ করাও যাবে না। তাতেও জনতা রেগে যাবে।

গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতেও প্রভাবশালী শ্রেণী ও অপরিহার্য শ্রেণী বিদ্যমান। তবে ইন্টারচেঞ্জেবল শ্রেণী বা আমজনতা যেহেতু তিনশ্রেণীতেই সময়ে সময়ে অবস্থান করে, বা ওভারল্যাপ করে, সেজন্য ক্ষমতার মসনদে যে বসে আছে, তাঁকে পুরস্কারের বন্টন বা সুযোগসুবিধার বন্টন বেশ সাবধানে করতে হয়। গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে প্রভাবশালী আর অপরিহার্য শ্রেণী সুযোগসুবিধা ঠিকই ভোগ করে, কিন্তু সেটা কখনোই ডিক্টেটরশিপে যেপরিমাণ একচেটিয়া সুযোগসুবিধা পায়, সেটার মত নয়।
যেমন গনতান্ত্রিক ব্যবস্থাতে গনতান্ত্রিক দলগুলো নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে। গনতান্ত্রিক দলগুলো চালাতে বড়বড় বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ফান্ডিং লাগে। টাকা লাগে। এসব বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতায় গিয়ে সুযোগসুবিধা দিতে হয়। সরকারি কনট্রাক্ট, ঠিকাদারি কাজ, এসব দিতে হয়।
গনতান্ত্রিক সরকারকেও একইভাবে প্রভাবশালী এবং অপরিহার্য শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। এরপর অবশ্য আমজনতার ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হয়।
যদি একটা দেশে সত্যিকার গনতন্ত্র থাকে, তাহলে সেইদেশে দুর্ভীক্ষ হলে পরবর্তী নির্বাচনে অবশ্যই ক্ষমতার পালাবদল হবে। এটা পানির মত পরিস্কার হিসাব।

যাই হোক, আমি গনতন্ত্র বলতে বাস্তব ও কার্যকর গনতন্ত্রের কথা বলছি। লোক দেখানো গনতন্ত্র না।

সুতরাং প্রফেসর ব্রুসের মতে,
মসনদ ও ক্ষমতার ধরণ যেমনই হোক,
ক্ষমতাধরকে-
প্রভাবশালী, অপরিহার্য এবং (বিনিময়ে/ আমজনতা),
এই তিন শ্রেণীকে ফেস করতে হবে।

এতোটুকু যা লিখলাম, সেটা হল ইন্ট্রোডাকশন। বা সূচনা।
এবার এই বিষয়গুলোকে ভালোমত বিশ্লেষণের জন্য উদাহরণ প্রয়োজন।
আমি আমার এই সিরিজ লিখাটি প্রফেসর ব্রুসের “ডিক্টেটরস হ্যান্ডবুক” বইটির বিশ্লেষণ ও এনালাইসিসের সাথে নিজের বিশ্লেষণ যোগ করে তুলে ধরবো।
এই লিখাটি লিখছি মুলত বইটির আলোকে।

যেমন, বইটিতে শুরুতেই যাকে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, তিনি ফ্রান্সের রাজা লুই-১৪

একেবারে সংক্ষেপে লুই’এর জীবনের ঘটনাগুলো তুলে ধরা যাক।


লুই মাত্র ৪ বছর বয়সে ক্ষমতার মসনদে বসেছিলেন। উনার বাবা মারা গিয়েছিলেন। ফলে রাজার ছেলে রাজা হলেন।
তো বুঝতেই পারতেছেন, মাত্র চার বছর বয়সে তো আর কেউকিছু বোঝে না। রাজ্য চালানো তো প্রশ্নই আসে না।
সুতরাং লুই-১৪ রাজা হিসেবে থাকলেও কার্যত রাজ্য পরিচালনা করতেছিলো তাঁর মা এবং সেইসাথে ফ্রান্সের এরিস্ট্রোক্র্যাট বা প্রভাবশালী শ্রেণী।
লুটেপুটেই চলতেছিলো রাজ্য শাসন। প্রভাবশালী শ্রেণী তথা ধনিক শ্রেণী ফ্রান্সকে রীতিমত দেউলিয়া করে ফেলেছিলো।
১৬৬১ সালে যখন লুই-১৪ এর বয়স ২৩ বছর, তখন যুবক লুই রাজ্যের সত্যিকারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেবার সিদ্ধান্ত নেন।
কিন্তু তিনি দেখলেন, নামকাওয়াস্তে তিনি রাজা। কার্যত দেশ চলে গিয়েছে এরিস্ট্রোক্রেসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। আর্মিও অসন্তুষ্ট। কার্যত দেশ দেউলিয়া। পলিটিক্যাল ক্রাইসিস যখন তখন শুরু হবে। এবং সেটা হলে লুই’এর গর্দান যাবে।
ওদিকে লুই খবর পেলেন, প্রভাবশালীরা চিন্তাভাবনা করতেছে ফ্রান্সের ক্ষমতার পালা বদলের। নতুন কাউকে ক্ষমতায় আনার। এটা মুলত একটা আইওয়াশ। অর্থাৎ দেশের দিশেহারা মানুষকে একটা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখিয়ে শান্ত করার। সেইসাথে ভবিষ্যতেও নিজেদের লুটপাটতন্ত্র চালু রাখার।
তো লুই-১৪ বেশ সাবধানে এগোলেন। নবীন আর্মি অফিসারদের প্রমোশন দিলেন, এবং বয়স্ক আর্মি অফিসারদের অবসরে পাঠালেন এবং নতুন মানুষদের রাজার “Inner Circle” বা পলিটিক্যাল ক্ষমতার প্রভাববলয়ের ভেতরে নিয়ে আসতে শুরু করলেন।
আর্মি অফিসার র‍্যাঙ্কে প্রচুর নিয়োগ দিলেন একেবারে আমজনতার ভেতর থেকে।
আর্মি আরোবেশি রাজনীতিতে ইনভল্ভ হতে শুরু করলো।
এটা করে তিনি মুলত পুরনো এরিস্ট্রোক্র্যাসির ভেতর ফ্রেশ ব্লাড সঞ্চালন করতেছেন। সেইসাথে একটা নতুন এরিস্ট্রোক্রেসি তৈরি করতেছেন যারা রাজার প্রতি কৃতজ্ঞ হবে এবং দায়বদ্ধ থাকবে। লুই খুব দ্রুত কাজটি করেছিলেন এবং আঘাত আসার আগেই তিনি পুরনো এরিস্ট্রোক্র্যাটদের টেকনিক্যালি আইসোলেট করে এবং পরে ক্ষমতার বলয়ের বাইরে ঠেলে দিয়ে ফ্রান্সের শাসনতন্ত্র এবং মসনদকে নতুনভাবে নিজেরমত করে গড়ে তোলেন।

সেইসাথে দীর্ঘদিন যারা প্রভাবশালী শ্রেণী হিসেবে বেশ আরামে ছিল, নিশ্চিন্তে ছিল, তাঁদের ভেতরই এবার কম্পিটিশন শুরু হয়ে গেল। নতুন ভার্সেস পুরনো।
এরা নিজেরাই নিজেদের অবস্থান ঠিক রাখতে নিজেদের ভেতর কম্পিটিসন শুরু করলো। ফলাফল, রাজা হটানোর চিন্তা আপাতত তাঁদের মাথা থেকে আউট।

আর এন্ড গেম হল, দিনশেষে লুই একেবারে লয়্যাল ইনার সার্কেল তৈরি করলেন একেবার নিজের হাতে গড়া লোক দিয়ে। পুরনো মানুষগুলোকে ঝেড়ে ফেলে।

এই লুই-১৪ গোটা ফ্রান্স সম্রাজ্যকেই বদলে দিয়েছিলেন পরে।
লুই-১৪ শাসনামলে ফ্রান্স ইউরোপের অন্যতম শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আটল্যান্টিকের অন্যপাশে, অর্থাৎ আমেরিকা মহাদেশেও ফ্রান্সের প্রভাববৃদ্ধি পায়। তাঁর তৈরি করা 'কোড অফ ল” পরবর্তীতে নেপোলিয়নিক কোড তৈরিতেও ইনফ্লুয়েন্স করে এবং আধুনিক ফ্রান্সের আইনের ব্যাসিকও এসেছে সেই লুই-১৪ এর কাছ থেকেই।
লুই যে আধুনিক ধাচের আর্মি গড়ে তুলেছিলেন নতুন করে, নতুনভাবে, সেটা পরবর্তীতে ইউরোপের অন্যান্য শক্তিশালী সম্রাজ্যগুলোও অনুসরণ করেছিলো।

সুতরাং রাজা লুই-১৪ ছোট বয়সেই বুঝেছিলেন, ক্ষমতায় থাকতে হলে আগে প্রভাবশালী শ্রেনীকে চেকইন দিতে হবে। নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে।
এরপর আসবে অপরিহার্য এবং বিনিমেয়রা...


(ধারাবাহিকভাবে সিরিজ আকারে বাকিঅংশ লিখা হবে)
ধন্যবাদ।
রেফারেন্স বইঃ “ডিক্টেটরস হ্যান্ডবুক” বাই প্রফেসর ব্রুস
Read More »